চট্টগ্রামে নৌকা ডুবিয়ে পেলেন আওয়ামী লীগের পদ, দুই উপদেষ্টাও ‘জামায়াতঘেঁষা’

দেড় বছর আগেও নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। নৌকা ডুবিয়েছেন সদলবলে। নৌকা ডুবানো সেই চেয়ারম্যান এখন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।

এ নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হওয়া মো. আবদুর রহিম চৌধুরী কখনও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন।

শুধু আবদুর রহিম নয় দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে এসেছেন বিতর্কিত অনেকেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের একসময়ের সক্রিয় একাধিক সদস্যও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে স্টাটাস দেওয়া মো. শহিদুল কবির সেলিমও হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। জামায়াত-বিএনপি ও বির্তকিতদের কমিটিতে রাখায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।

সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ৭৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করা হয়। ওই কমিটিতে ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে চন্দনাইশের বরকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহিমকে। তিনি ২০২২ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে আনারস প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন।

দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই বলছেন, স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করা নেতাদের প্রায় সবাইকে শাস্তির আওতায় এনেছে দলটি। অভিযুক্ত বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলে ফেরানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তবুও আবদুর রহিম জেলা ইউনিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে স্থান পেয়ে গেলেন।

পূর্ণাঙ্গ কমিটির একাধিক নেতা বলেন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার আশ্রয়ে আবদুর রহিম অনুপ্রবেশ করবেন— এমন গুঞ্জন ছিল। এরপর আবদুর রহিম জামায়াত ও শিবিরের রাজনীতিতে জড়িত থাকার নথিপত্র আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কাছে অভিযোগ আকারে দেওয়া হয়। তবুও অদৃশ্য শক্তিতে রাতারাতি আবদুর রহিম বনে গেলেন আওয়ামী লীগ নেতা। অথচ যার প্রাথমিক সদস্যপদও থাকার কথা নয়।’

তবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. আবদুর রহিম চৌধুরী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ থেকে বিদ্রোহীদের ক্ষমা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দলের জন্য কাজ করছি। তাই দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে। এটি অনেকের সহ্য হচ্ছে না। ভুয়া কাগজ বানিয়ে অপপ্রচার করছে।’

আবদুর রহিম চৌধুরী দাবি করেছেন, জোট সরকারের আমলে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ও তার ভাই নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা হওয়া অধ্যাপক ড. এএইচএম সেলিম উল্লাহ সাদা দলের সক্রিয় সদস্য। তাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট নিয়োগ করা হলে ছাত্রলীগের প্রতিবাদের মুখে সরিয়ে নেওয়া হয়। আরেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনও একসময় বিএনপি-জামাতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সদস্য ছিলেন বলে প্রচার রয়েছে। এমন চিহ্নিত আওয়ামী লীগ বিরোধীদের উপদেষ্টা করায় বিষ্ময় প্রকাশ করছেন ছাত্রলীগ নেতারা।

এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আসা এক মুক্তিযোদ্ধা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেলা আওয়ামীগের এই কমিটিতে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন। বরকল ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সভাপতি এখন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন আ. লীগের বড় নেতা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটি মেনে নেওয়া আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টের। এই শিবির নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে অনেক আগে৷ তবুও কোন জাদুবলে সে আওয়ামী লীগের নেতা বনে গেল আমি জানি না।

চন্দনাইশ থানা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদাউসুল আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আবদুর রহিম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। তিনি একসময় জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং বরকল ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। হুট করে ২০১৮ সালের পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগ করা শুরু করেন। গত বছর তিনি নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনও করেছেন। তাছাড়া তিনি একটি ফৌজদারি মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিকে আমাদের নেতারা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে রেখেছেন। অথচ তার প্রাথমিক সদস্য পদও থাকার কথা নয়।’

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল থেকে বিদ্রোহীদের ক্ষমা করা হয়েছে। আমরা কেন্দ্রের সঙ্গে আলাপ করে তাদের কমিটিতে রেখেছি। তবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে না রাখার নির্দেশনা আছে।’

উপদেষ্টার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জেনেছি। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কমিটিতে ‘টাকার দিয়ে পদ বাগিয়ে নেওয়া’ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদাউসুল আলমের বক্তব্য প্রসঙ্গে মফিজুর রহমান বলেন, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি তাকে সম্মান করি। আমারও দীর্ঘ রাজনৈতিক সুনাম রয়েছে। আমি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ওনার মুখে এ ধরনের মন্তব্য আমার চরিত্রহননের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। হিংসা-বিদ্বেষ ও চরিত্রহননের রাজনীতি কাম্য নয়।’

আরএম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!