চট্টগ্রামে ছাত্রদলের পায়ে ছাত্রলীগের ‘পাড়া দিয়ে ঝগড়া’, পিটিয়ে পদত্যাগপত্র নেওয়ার নালিশ

প্রায় এক দশকের মাথায় চট্টগ্রাম নগরীর ২৬টি ইউনিটে একযোগে কমিটি ঘোষণা করেছে মহানগর ছাত্রদল। ঘোষিত কমিটির মধ্যে ১৪টি কলেজ ইউনিট এবং ১২টি থানা ইউনিট। এসব কমিটি অনুমোদনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক মাঠের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব কমিটিকে ঘিরে সমালোচনায় মেতে উঠতে দেখা গেছে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এর মধ্যেই কমার্স কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়কের কথিত ‘পদত্যাগের’ একটি চিঠিও ভেসে বেড়াচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাদের টাইমলাইনে। আবার এর নেপথ্যে বাসা থেকে তুলে এনে মারধর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগও মিলেছে। এখন পর্যন্ত এর বাইরে বাকি সব কিছুই হচ্ছে ফেসবুকে। রাজনীতির মাঠে এসব কমিটির কোনো তৎপরতা এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

ছাত্রদলের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কমিটি ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ফেসবুকে নানারকম হুমকিধমকি দেওয়া ছাড়াও তাদের নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে গিয়েও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাসা থেকে ধরে এনে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কমার্স কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ককে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে সেটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে বলেও অভিযোগ ছাত্রদলের। এই পরিস্থিতিতে আপাতত পরিস্থিতি ‘অবজার্ভ’ করছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

যদিও এই অভিযোগের বিষয়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও নগর ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি, তবে ছাত্রদলের কমিটির ইস্যুতে ছাত্রলীগ নেতাদের এমন আগ্রাসী ভূমিকার সমালোচনা উঠছে দলটির ভেতর থেকেই। অন্যদিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারাও এসব কর্মকাণ্ডকে নেতিবাচক দাবি করে বলছেন এসব কিছু ভাল ফল বয়ে আনবে না। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে উদার ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক চর্চা করার পরামর্শ দিচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারাও।

শনিবার (৯ এপ্রিল) রাতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ দফতর সম্পাদক আজিজুল হক সোহেল স্বাক্ষরিত এক পত্রে চট্টগ্রামে ছাত্রদলের কমিটিগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. সাইফুল আলম ও সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে ২৬টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করা হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. সাইফুল আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর কলেজ ও থানা কমিটিগুলো দেওয়া শুরু করেছি। বাকি ইউনিটের কমিটিও শিগগির ঘোষণা করা হবে। যেসব ইউনিটে কমিটি হয়েছে, তারা কাউন্সিল ও সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করবে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের পর নগরীর চট্টগ্রাম কলেজ, সিটি কলেজ, মহসিন কলেজ, ওমরগণি এমইএস কলেজ, কমার্স কলেজসহ ১৪টি কলেজে আহ্বায়ক কমিটি দিতে পেরেছে নগর ছাত্রদল।’

এর পরই চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর তার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ‘নগরীর বেশকয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেইসবুকে ভাসমান ছাত্রদলের কমিটি দৃষ্টিগোচর হলো। বঙ্গবন্ধুর খুনি জিয়াউর রহমানের কুখ্যাত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ পরিহার করে এবং খালেদা তারেক জিয়ার দুর্নীতির মহাকর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নের লাঠিয়াল বাহিনী না হয়ে ,সুপথে ফিরে এলেই তবে উড়ো চিঠি না মেরে প্রকৃত অস্তিত্ববান হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে তারা।’

ফেসবুকের ওই পোস্টে ছাত্রদলের এসব কমিটিকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি হুঁশিয়ার করে জাকারিয়া দস্তগীর লিখেছেন, ‘কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড না থাকার পরও, চোরাগোপ্তা হামলার মত চোরাগোপ্তা কমিটিতে স্থান পাওয়াদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আহবান, যাদের নাম দেখছি, কিন্তু পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন যেহেতু নয় সেক্ষেত্রে যে ইউনিটগুলোর কমিটি ছাত্রদল দিয়েছে তাদের পরিচয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করলে অবশ্যই সাধুবাদ পাবে। না হয় সেই বিখ্যাত ডায়লগে অভিনন্দন বাধাগ্রস্থ হবে ‘কোথাও কেউ নেই।’

শুধু জাকারিয়া দস্তগীরই নয়, নগর ছাত্রদলের এসব কমিটিকে কাগুজে কমিটি হিসেবে অভিহিত করে বিভিন্ন রকমের প্রচ্ছন্ন শ্লেষ ও হুমকি-ধামকি দিতে দেখা গেছে ছাত্রলীগের দায়িত্বশীল অনেক নেতাকেই।

ছাত্রলীগের এই হুমকি-ধমকির মধ্যেই রোববার (১০ এপ্রিল) রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমার্স কলেজ ছাত্রদলের আহ্বাবায়কের পদত্যাগের ছবি বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। ছাত্রদলের ওই কমিটির ঘোষিত আহ্বায়ক মেহেদী হাসান রায়হান ‘স্বাক্ষরিত’ সেই পদত্যাগপত্রে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কমার্স কলেজ শাখার কমিটিতে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আহ্বায়ক করা হয়েছে। আমি সদ্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায়, ছাত্রদলের সাংগঠনিক যোগ্যতা হারাই। আমি ছাত্রদলের সাংগঠনিক সকল কর্মকাণ্ডে দায়ভার নিতে সম্পূর্ণ অপারগতা প্রকাশ করে স্বজ্ঞানে ও স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারি কমার্স কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করিতেছি।’

তবে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেছেন, কমার্স কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ককে বাসা থেকে তুলে এনে মারধর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা।

এই ছাত্রদল নেতা বলেন, ‘২৬টা কমিটি দেওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতারা বিভিন্নভাবে ফেসবুক থেকে শুরু করে ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। যেমন গতকাল (১০ এপ্রিল) কমার্স কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ককে বাসা থেকে তুলে এনে মারধর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নিয়েছে ছাত্রলীগের নেতারা। এখন আমরা অনেক কিছুই আপাতত ছেলেদের নিরাপত্তার স্বার্থে সামনে আনছি না।’

হুমকি বা মারধরের এমন ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় জানিয়েছেন কিনা কিংবা কোন আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে ‘না’ সূচক উত্তর দেন নগর ছাত্রদলের এই সদস্য সচিব। কেন পুলিশকে এই বিষয়ে জানাননি— এমন প্রশ্নের জবাবে তুহিন বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসনের অবস্থান তো সকলেই জানে। এসব ইস্যুতে প্রশাসন থেকে আমরা কতটুকু সহযোগিতা পাবো তা তো আমরা জানি। আমরা বিষয়গুলো অবজারভ করতেছি। এখন প্রতিটা ঘটনায় তো আমরা আলাদা আলাদা করে ব্যবস্থা নেবো না। আমরা আরও পরিস্থিতি কী হয় তার ওপর বসে সিদ্ধান্ত নেবো। এর মধ্যেই আমরা সাংগঠনিক আলাপ আলোচনা করছি।’

তবে ছাত্রলীগ নেতাদের এসব কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করে নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিন বলেন, ‘ছাত্রলীগ তো গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করে না। এরা চরদখলের মত বিভিন্ন কলেজ ক্যাম্পাস দখল করে রাখছে। ভিন্নমত এরা একেবারেই সহ্য করতে পারছে না।’

পাশাপাশি ছাত্রদলের কমিটির বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ নাকচ করে তিনি বলেন, ‘এগুলো কোনটাই নামসর্বস্ব কমিটি নয়। আমরা সাংগঠনিক রিপোর্ট জমা দিয়ে আগ্রহীদের নাম আহ্ববান করেছি। আগ্রহীদের মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করেই আমরা কমিটি অনুমোদন দিয়েছি। আমরা পরিস্থিতি অবজার্ভ করছি। ছেলেদের নিরাপত্তা তাদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। তবে এই কমিটি সবগুলোই বহাল থাকবে। এদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও শীঘ্রই দৃশ্যমান হবে।’

এই বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে নাম পরিচয় দিয়ে নগর ছাত্রদলের কমিটি ইস্যুতে ছাত্রলীগ নেতাদের ভূমিকা নিয়ে নগর ছাত্রদলের অভিযোগের বিষয়ে তার মতামত জানার বিষয়টি তুলে ধরে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিলে তিনি ইফতারের পর কল করবেন বলে জানান। ইফতারের পর তিনি কল না করায় তাকে হোয়াটসঅ্যাপে আবার ম্যাসেজ দিলে তিনি ম্যাসেজ সিন করেও কোনো উত্তর দেননি। কল করা হলেও রিসিভ করেননি।

তবে এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা আসছে ছাত্রলীগের ভেতর থেকেই। শাহাজাদা চৌধুরী নামের একজন ছাত্রলীগ নেতা তার ফেসবুক টাইমলাইনে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘গতকাল ছাত্রদলের কমিটি হবার পর একটা ফান পোস্ট করেছিলাম। সেখানে ওমরগনি এমইএস কলেজ ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পাওয়াদের নিয়ে মজা করে কিছু কথা বলেছিলাম। সেটাও অনুচিত ছিল। কিন্তু অনেক সহযোদ্ধা, যারা নিজেদের কলেজের নেতৃত্বে আছেন তারা পুরো নগরজুড়ে নানান থানা ও কলেজ ছাত্রদলের কমিটিগুলো হবার পর যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন সেটা আমার কাছে খুব বেশি বেমানান লেগেছে। আচ্ছা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখে— এমন কোন ছাত্রসংগঠন কমিটি দিলে তাতে সমস্যা কোথায়?’

ঠিক কী কারণে এই সমালোচনা করছেন তা ব্যাখা করে শাহজাদা চৌধুরী আরও লিখেছেন, ‘একটা কলেজে আজ যদি ছাত্রদলের ব্যানারে কেউ রাজনীতি করতো সেখানে কি ছাত্রলীগের জন্যে চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়াতো না? এই চ্যালেঞ্জ কি ছাত্রলীগের জন্যে মঙ্গলকর হতো না? ছাত্রলীগ এখন যেমন রাজনীতি করে, তার বিকল্পধারায় চলতে বাধ্য হতো না? তবে কি ছাত্রলীগ এই চ্যালেঞ্জকে ভয় পায়? তাই ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়েই ছাত্রদলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর বদলে হুমকি ধমকি দিচ্ছে? ছাত্রলীগের এই আচরণ আসলেই ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের মানসিকতা কোন দিকে ধাবিত হয়েছে তার উদাহরণ হতে পারে। ছাত্রদের ভাষা হবে সুশ্রী, সন্ত্রাসীদের মত না। ছাত্রলীগ এমন আচরণ করলে এটাকে পুঁজি করে ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী (সংগঠন) বানানোর যে পাঁয়তারা চলছে তার সুযোগ আরও বেড়ে যাবে।’

এরশাদ সরকার ও বিএনপি আমলে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন মফিজুর রহমান। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের যুদ্ধংদেহী অসহিষ্ণু আচরণের বিষয়ে তার অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো কিন্তু রাজনীতির জন্য কখনোই শুভ লক্ষণ নয়। রাজনীতিতে সহ-অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মনে করি দখল বা জোর করে কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার চর্চা উচিৎ না। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার দরকার। এখন যেগুলো চলছে তাতে আমি মনে করি ছাত্ররাজনীতি সঠিক ধারায় নাই।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!