চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির কঠিন চক্র— বিদেশ থেকে আসে সাজ্জাদের ফোন, চাঁদা তোলেন হারুন-মুন্না

বায়েজিদ-চান্দগাঁওয়ে ত্রাসের রাজত্ব

কখনও মধ্যপ্রাচ্য, কখনও আবার ভারতে বসে চট্টগ্রামে ফোন করে চাঁদা চান সাজ্জাদ হোসেন খান। কখনও দেন সরাসরি হুমকিও। আর চট্টগ্রামে বসে সেই চাঁদা তোলেন তার সহযোগী হারুন-মুন্নাসহ তাদের সহযোগীরা। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে বোমা হামলা থেকে গুলি বর্ষণ, এমনকি খুন করতেও পিছ পা হন না তারা। এভাবে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকায় রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে এই চক্রটি। ব্যবসায়ী থেকে প্রবাসীরাও এই চক্রের অন্যতম টার্গেট। সাজ্জাদের অবর্তমানে তার প্রধান সহযোগী হারুনের অধীনে কয়েকশত সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকা। উঠতি কিশোর-যুবকদের টার্গেট করে টাকার লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয় তাদের। পরে তাদের হাতে অস্ত্র ও টাকা তুলে দিয়ে চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে।


সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের ১৫ মার্চ চাঁদা না পেয়ে পাঁচলাইশ এলাকার এক বাড়িতে গুলি বর্ষণ ও পেট্রল ঢেলে আগুন দিচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদের সহযোগী হারুন ও আজিজ মোহাম্মদ। চলতি বছরের ২২ মার্চ চাঁদা না পেয়ে বায়েজিদ নয়ারহাট এলাকায় এক ব্যবসায়ীর অফিসে অস্ত্র হাতে হামলা-তাণ্ডব চালায় হারুন ও তার সহযোগীরা।

প্রায় একযুগ আগে ছিঁচকে চোর ও ছিনতাইকারী হিসেবে চট্টগ্রামের অপরাধজগতে হাতেখড়ি হারুন-উর-রশীদের। মোটরসাইকেল চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ কয়েকবার কারাগারেও যান তিনি। ২০১১ সালে বায়েজিদ থানার একটি চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতার হন হারুন। আর এই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ খান। ওই সময় সাজ্জাদের নির্দেশে বায়েজিদ ও চান্দগাঁও থানা এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদাবাজি, চাঁদা না দিলে ভবন মালিকের বাসস্থান কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-গুলি বর্ষণ করার কাজে ব্যবহার করা হতো হারুন ও উঠতি কিশোর-যুবকদের। বিনিময়ে তাদের দেওয়া হতো পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা। এভাবে পর্যায়ক্রমে সন্ত্রাসী সাজ্জাদের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন ছাত্রশিবির কর্মী হারুন।

২০১৫ সালের পর সাজ্জাদ বাহিনীর নেতৃত্বের ভার আসে হারুনের হাতে। গড়ে তোলেন নিজস্ব গ্রুপও। সাজ্জাদের নামেই এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে বেপরোয়া সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বায়েজিদ নয়ারহাটের সালেহ আহমদের ছেলে হারুন উর রশীদ। সাজ্জাদের নির্দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থেকে নাশকতায়ও তার হাত রয়েছে— এমন অভিযোগও মিলেছে। এভাবে একের পর এক ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে হারুন হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ ক্যাডার।

গত ছয় বছরে অন্তত দশটি মামলা হয়েছে হারুনের বিরুদ্ধে। তবে তিনি সবসময়ই থেকেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে। বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকায় বাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে জমি ক্রয়-বিক্রয়, শিল্প কারখানা, বাড়ির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে গেলেও সাজ্জাদের হয়ে চাঁদার জন্য হানা দেন হারুন। নয়ারহাট কাঁচাবাজার, সড়ক-ফুটপাতের ভাসমান দোকানপাট, ব্যাটারি রিক্সাসহ পরিবহন খাতেও প্রতিদিন চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন হারুন।

সর্বশেষ গত ২০ জুলাই গভীর রাতে বায়েজিদ এলাকার ‘হোমটেক্স’ নামক একটি ফ্যাক্টরিতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আলোচিত ঘটনায়ও নেতৃত্ব দেন হারুন। এ ঘটনায় তার চার সহযোগী গ্রেপ্তার হলেও যথারীতি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান হারুন। এর আগে ১৮ ও ১৯ জুলাই ওই কারখানার মালিকের কাছে বিদেশ থেকে সাজ্জাদ ফোন করে চাঁদা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর ওই হামলা চালানো হয়।

জানা গেছে, ‘যতো আতঙ্ক ততো টাকা’— এই নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে গ্রুপটির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। জনমনে ভীতি ছড়িয়ে দিতে পেট্রল বোমা হামলা, গুলি বর্ষণ কিংবা খুন করতেও পিছপা হয় না তারা। তুচ্ছ বিষয়ে অস্ত্র প্রদর্শন, ফাঁকা গুলি ছোঁড়া কিংবা অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়ে প্রায়ই আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন হারুন। তবে আজ পর্যন্ত হারুনের হেফাজতে থাকা একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিকে বায়েজিদ থানাধীন আপন নিবাস আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন একটি ভবন মালিকের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন সন্ত্রাসী সাজ্জাদ। না দিলে দফায় দফায় হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত গত ২২ মার্চ নির্মাণাধীন এই ভবন মালিকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দলবল নিয়ে অস্ত্র হাতে তাণ্ডব চালান হারুন। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে বায়েজিদ থানায় দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলা করেন। সেই মামলার অন্যতম আসামি হারুন ও তার সহযোগী আমিনুর রহমান সুমন, মোহাম্মদ ওসমানসহ আরও কয়েকজন।

২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে বায়েজিদ থানার নয়ারহাট এলাকার ‘ছায়াপথ কুটির’ নামের একটি বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে ব্যবসায়ী তানভীরুল হককে অপহরণ করেন হারুন। সাজ্জাদকে চাঁদা না দেওয়ায় তাকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তবে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান তানভীর। এ ঘটনায় তিনি বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হারুন ও তার সহযোগী কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

গত ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে বায়েজিদ থানার ওয়াজেদিয়া এলাকায় এক প্রবাসীর বাড়িতে পেট্রল বোমা হামলা চালান হারুন। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর বিবিরহাট এলাকায় চাঁদা না পেয়ে একটি ভবনে গুলিবর্ষণ ও পেট্রল ঢেলে আগুন দেন হারুন, আজিজ মোহাম্মদ ও মাসুদ। এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আলোচিত হয়েছিল সে সময়।

চট্টগ্রাম নগরীতে এযাবৎকালে ছাত্রশিবিরকেন্দ্রিক যতো দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর উত্থান হয়েছে, তার অধিকাংশেরই উত্থান চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে। এদের কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, কেউবা আবার প্রতিপক্ষের গুলিতে। কেউ এখন কারাগারে রয়েছেন, কেউ আবার বিদেশে আত্মগোপনে। এদেরই একজন সাজ্জাদ হোসেন খান।

১৯৯৯ সালের ২ জুন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে অপরাধজগতে উত্থান সাজ্জাদ খানের। এভাবে একে একে অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন এই শিবির ক্যাডার। একটি অস্ত্র মামলায় সন্ত্রাসী সাজ্জাদের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ২০০০ সালের ১২ জুলাই বহদ্দারহাট এলাকায় প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ারে ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মী হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলেও হাইকোর্টে তিনি অব্যাহতি পান। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা বিচারাধীন এবং সাতটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

২০০১ সালের ২ এপ্রিল সাজ্জাদ একে-৪৭ রাইফেলসহ চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন। এর বছর দেড়েক পর জামিনে কারাগার থেকে বের হন। চট্টগ্রামের কারা ফটক থেকে তাকে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন একজন সাংসদ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপর তিনি গোপনে দুবাই চলে যান।

২০১২ সালের ৭ নভেম্বর ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরে গ্রেপ্তার হন সাজ্জাদ। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে তিনি পাঞ্জাবের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। তাদের একটি সন্তানও আছে।

সাজ্জাদ হোসেন খানকে পরবর্তী তিন বছর ধরে চেষ্টা করেও বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাকে ফিরিয়ে আনতে ২০১২ সাল থেকে ভারতকে সাতটি স্মারকে বহিঃসমর্পণ প্রস্তাব পাঠানো হলেও সেগুলোর তথ্য আংশিক ও অসম্পূর্ণ থাকায় শেষ পর্যন্ত সাজ্জাদ থেকে যান অধরাই। এ ছাড়া নতুন জটিলতা দেখা দেয় সাজ্জাদ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেকে মো. আবদুল্লাহ বলে দাবি করায়। এ পরিচয়ে ভারতীয় পাসপোর্টও রয়েছে তার। সাত বছর আগে সর্বশেষ তিনি দিল্লির তিহার কারাগারে বন্দি ছিলেন। পরে অবশ্য সেখান থেকে জামিনে বেরিয়ে যান সাজ্জাদ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সাজ্জাদ কখনও মধ্যপ্রাচ্যে, কখনও আবার ভারতে বসেই চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। জানা গেছে, অস্ত্র কেনার জন্য এই সাজ্জাদের সহযোগীরা ২০১১ সালে পাঁচলাইশের শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছিল।

এদিকে গত ৩ আগস্ট নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে গ্রেপ্তার হন সাজ্জাদের সেকেন্ড-ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত বেলাল উদ্দিন মুন্না। তাকে ফোম কারখানার একটি মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। তবে যে কোনো সময় জামিনে তিনি মুক্ত হতে চলেছেন— এমন খবর রয়েছে। কাউন্সিলর লিয়াকত আলী হত্যা ছাড়াও ছাত্রলীগ নেতা এনাম-মনছুর-শহীদ ট্রিপল মার্ডারসহ অন্তত ডজনখানেক মামলার আসামি এই মুন্না।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হারুনের অধীনে কয়েকশত সন্ত্রাসী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বায়েজিদ ও চান্দগাঁও এলাকায়। পুলিশের নজরজারিতে আছে বিষয়টি। আমাদের গোপন অভিযান অব্যাহত আছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা গ্রেপ্তার হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদ এখন দেশের বাইরে আছে।  তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!