চট্টগ্রামের ৭ উপজেলায় নেই দাঁতের সার্জন, হাতুড়ের হাতেই শেষ রোগী

উপজেলায় পোস্টিং পেয়ে ডেপুটেশনে ডাক্তার চলে যান শহরে

চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতে দাঁতের চিকিৎসা পাচ্ছে না মানুষ। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নেই ডেন্টাল সার্জনও। ফলে রোগ সারাতে রোগীদের ভরসা গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার। আবার অনেকে চিকিৎসা নিতে দেরি করে জটিল করছেন রোগ। ১৫ উপজেলার সাতটিতেই নেই কোনো ডেন্টাল সার্জন। এছাড়া উপজেলায় পোস্টিং পাওয়া দাঁতের ডাক্তাররা চলে যান ডেপুটেশনে।

এদিকে গ্রামে ডাক্তার না থাকার সুযোগে চেম্বার খুলে বসেছে হাতুড়ে ডাক্তার। তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের জটিল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। শেষ সময়ে চিকিৎসা নিতে রোগীদের ছুটতে হয় নগরীতে।

জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ার বছর চারেক আগে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আর এজন্যই অকেজো হয়ে পড়ে ডেন্টাল ইউনিট। ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দন্ত বিভাগে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন টেকনোলজিস্ট রয়েছেন।

ডেন্টাল ইউনিট অকেজো থাকায় চার বছর ধরে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসা সাধারণ রোগী। বিভাগটিতে চিকিৎসক থাকলেও যন্ত্রপাতির অভাবে তারা কাজ করতে পারছেন না। ডেন্টাল সার্জারি, ফিলিং, স্কেলিং, দাঁত ওঠানোসহ কোনো চিকিৎসাই মিলছে না হাসপাতালে।

একই অবস্থা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে। এখানে প্রায় সাত বছরের অধিক সময় ধরে অকেজো হয়ে পরিত্যক্ত পড়ে আছে ডেন্টাল মেশিন। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। দাঁতের কিছু চিকিৎসা সার্জারি নির্ভর হওয়ায় মেশিন অকেজো থাকায় দন্ত চিকিৎসক থাকার পরেও দাঁতের পরিপূর্ণ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বহির্বিভাগে আগত রোগীরা।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে ডেন্টাল সার্জনের পদ থাকলেও সেসব পদ শূন্য রয়েছে বছরের পর বছর। কারণ ওই পদে নিযুক্ত ডেন্টাল সার্জনরা ডেপুটেশনের নামে চলে আসেন শহরে। এদিকে গ্রামের মানুষ সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে এলাকার হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। কৃত্রিম দাঁত প্রতিস্থাপন, স্কিলিং, ফিলিং, দাঁত ও মাড়ির রোগের চিকিৎসায় এসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। আর এই ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে। প্রতি সপ্তাহে ঝুঁকিপূর্ণ অন্তত অর্ধশত দাঁতের রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন।

এছাড়া গ্রামের ডায়াবেটিকস রোগীদের পেরিডেন্টাল ডিজিসের ঝুঁকি খুব বেশি। তাদের দাঁতের গোড়া বা মাঁড়িতে নানা সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ধরনের রোগী যখন গ্রামে চিকিৎসা না পেয়ে শহরে আসে ততদিনে অবস্থা খারাপের দিকে চলে যায়।

এদিকে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন ডেন্টাল সার্জন থাকার কথা থাকলেও তা নেই চট্টগ্রামের সাত উপজেলায়। এই সাত উপজেলা হচ্ছে-রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও মিরসরাই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের বহির্বিভাগে প্রতি সপ্তাহে ৪৫ থেকে ৫০ জন রোগী পাওয়া যায়, যারা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে ক্যান্সার পর্যায়ে চলে যান। এসব রোগীর বেশিরভাগই দাঁতের ক্ষত থেকে ক্যান্সারের আক্রান্ত। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মূলত হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করিয়ে পরে আসেন এখানে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট স্থাপন করা হলেও সেখানে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসক দিয়ে চলছে এই ইউনিট। ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসকরা বছরের পর বছর শহরে থাকায় এই ইউনিটে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয় না।

বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় অনুমোদনবিহীন গড়ে উঠেছে দন্ত চিকিৎসালয় । দু’বছর আগে রাউজান উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে হাতুড়ে ডাক্তার দীপক কুমার শীলের‘ ফ্রেস ভিউ ডেন্টার কেয়ারে’ তালা লাগিয়ে দেন। তাকে জরিমানা করা হয় পাঁচ হাজার টাকা। আর কোনোদিন দাঁতের চিকিৎসা করবে না মর্মে মুচলেকা দেন তিনি। কিন্তু এরপরও বহাল তবিয়তে চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন হাতুড়ে ডাক্তার দীপক কুমার শীল।

এছাড়া একইদিন রাউজানের মুন্সিরঘাটায় হাতুড়ে দন্ত চিকিৎসক সনজিৎ দাশ, কায়েদে আজমের চেম্বারও সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে তারা আবারও চেম্বার খুলে দাঁতের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন লোকজনকে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক মনজুরে-ই-মাহমুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মফস্বলে দাঁতের চিকিৎসায় হাতুড়ে ডাক্তাররা সঠিক জ্ঞানের অভাবে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নেন। হাতুড়ে ডাক্তাররা ফিলিং ও নকল দাঁত তৈরিতে সাধারণত ব্যবহার করেন সেল্ফ কিউর রেজিন নামে এক ধরনের উপাদান যা মূলত এক ধরনের প্ল্যাস্টিক আইটেম। সুবিধা হচ্ছে, এই উপকরণটি দিয়ে তারা অল্প সময়ে নকল দাঁত তৈরি বা ফিলিং করে দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা দীর্ঘ সময় ধরে মুখে থাকার কারণে এর থেকে ক্যান্সার হওযার আশঙ্কা থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা দাঁতের গোড়া অবশ করতে ইথাইল ক্লোরাইড অথবা ফরমাল ডিহাইড নামের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন, যা মুখের টিস্যুগুলোকে বার্ন করে দেয়। এর থেকে প্রথমে ঘা হয়, পরে সেখানে ক্যান্সার হয়।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াছ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি, দেখি ভালো ফল আসে কিনা। ততদিনতো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!