চট্টগ্রামের শিক্ষাঙ্গনেও ফিরেছে প্রাণ, শ্রেণিকক্ষে ফিরল শিক্ষক-শিক্ষার্থী

৫৪৩ দিন পর খুললো স্কুল-কলেজ

প্রতিদিনের সকালের মত আজকের সকালটা একরকম ছিল না। এদিন সকাল ৬টা থেকে মা-বাবার হাঁক-ডাক। সন্তানকে তৈরী করে স্কুলে পাঠানোর তাগিদ। সন্তানের চোখে-মুখে ঘুম। সেই ঘুমচোখেই প্রস্তুত হয়ে রায়হান নাস্তা খেয়ে স্কুলে রওনা দেয়। গন্তব্য চট্টগ্রাম নগরীর গণপূর্ত বিদ্যানিকেতনে। রাস্তায় তার বন্ধু সজীবের সাথে দেখা। স্কুলে প্রবেশ করতেই সেই পুরোনো সব বন্ধু। ঘুম ছুটে চোখে ভর করে খুশির ঝিলিক। স্কুলের প্রবেশ পথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাশরুমে গিয়ে বসা। তারপর শুরু পাঠদান। ৫৪৩ দিন পর রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) স্কুল খোলার প্রথম দিনে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের স্কুলে গমন ও ক্লাশরুমে বসার চিত্র ছিল এমনই। সকালের শিফটে শিক্ষার্থীরা সুশৃঙ্খলভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে প্রবেশ করেছে।

করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে গেল বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় প্রথম ধাপে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে আজ থেকে। শারীরিক উপস্থিতিতে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগে থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত করার নির্দেশনা ছিল। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। শ্রেণি কার্যক্রম প্রস্তুতি ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বরণ করতে সাজানো হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শ্রেণিকক্ষ। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাথমিকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুইটি শ্রেণির পাঠদান অনুষ্ঠিত হবে। সে অনুযায়ী একটি রুটিনও প্রণয়ন করা হয়েছে। রুটিন অনুযায়ী, রোববার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির ক্লাস অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিষয়টি না জেনে অনেক অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরও স্কুলে চলে আসতে দেখা গেছে।

স্কুল খোলার প্রথম দিন চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের আগমন উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাজসাজ রব বিরাজ করছে। অনেক স্কুলেই শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হয়, স্কুল গেইট সাজানো হয় বেলুন দিয়ে।

নাসিরাবাদ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাসমত জাহান জানান, ‘সাড়ে আটটা থেকে স্কুল শুরু হওয়ার নিয়ম থাকলেও শিক্ষার্থীরা সকাল আটটার মধ্যেই স্কুলে চলে এসেছে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করিয়েছি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, শরীরের তাপমাত্রা মাপা, শরীরে স্যানিটাইজ করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম শিফট সাড়ে আটটা থেকে শুরু হবে। পঞ্চম, ষষ্ঠ, দশম শ্রেণির নতুন ও পুরাতন দুই শ্রেণির ক্লাশ চলবে। সকাল সাড়ে এগারটার দ্বিতীয় শিফটেও তাই হবে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক।’

রেলওয়ে পাবলিক স্কুলের অধ্যক্ষ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সকালের শিফট ৯টা থেকে শুরু। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করানো হয়েছে।’

এদিকে কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানজিদা মোখতার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি বিশেষ মনিটরিংয়ের কথাও জানান। তিনি বলেন, ‘তার স্কুলে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত ক্লাস চলবে। স্কুলের পাশাপাশি একাদশের ৩টি সেকশনে ও দ্বাদশ শ্রেণির নিয়মিত ক্লাশ চলবে আজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘হ্যান্ডস্যানিটাইজার, শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয়, মাস্ক পড়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করানো হচ্ছে। যারা মাস্ক পড়ে আসেনি তাদের স্কুল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্লাশে মনিটরিং করা হবে। আর শিক্ষকদের একটি গ্রুপ রাখা হয়েছে তারা আজ ক্লাস না নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মানছে কিনা শুধু মনিটরিং করবে।’

এদিকে সকাল থেকেই স্কুলের সামনে অভিভাবকদের ভিড় দেখা যায়। সন্তানকে বাসা থেকে বের করে স্কুল অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করা গেছে। করোনা মহামারিতে সন্তানকে চোখে চোখে রেখে আজই বাসার বাইরে অন্য কোথাও রেখে যাওয়া। মাধুরী রানীর বাসা নগরীর হেমসেন লেনে। মেয়েকে খাস্তগীর স্কুলে দিতে এসে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। উৎকণ্ঠা নিয়েই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানালেন, ‘এ সময়ে মেয়েকে স্কুলে দিতে এসে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বাসার বাইরে বের হলেই নিরব একটা ভয় কাজ করে নিজের মধ্যে।’

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্কুল ও কলেজ খোলার পর উচ্চ মাধ্যমিক ২০২১ ও ২০২২ সালের মাধ্যমিক এবং এ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার (পিইসিই) শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন ক্লাস করবে। প্রথম থেকে চতুর্থ ও ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন করে সশরীরে ক্লাস করবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের কাছে স্বাস্থ্য নির্দেশনার সাধারণ পরিচালন পদ্ধতি (এসওপি) পাঠিয়েছে। স্কুলে ক্লাস শুরু হওয়ার পর নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে হবে।

এই নির্দেশনায় প্রধান শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, সব শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মীদের সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকা এবং শ্রেণীকক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া, কোনো শিক্ষার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকা অথবা কর্মীর করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া, শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে বা আইসোলেশনে থাকতে পারবে এবং তাদেরকে অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হবে না।

নির্দেশনায় শিক্ষকদের অনুরোধ করা হয়েছে, প্রতিটি ক্লাসের শুরুতে একটি অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য। কোনো ছাত্র যেন ক্লাসের মাঝখানে বের হয়ে না যায়, সেটা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে নির্দেশনায়। এসওপি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে— তারা যেন যে কোনো ধরনের অসুস্থতার কথা শিগগির অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জানায়। কোনো জরুরি কারণ ছাড়া শ্রেণীকক্ষের বাইরে না যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, পরিবারের কোনো সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যেন তারা শিগগির এই তথ্যটি প্রধান শিক্ষককে জানান। একইসঙ্গে, শিশুদের বাইরের খাবার খেতে নিরুৎসাহিত করার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে এসওপিতে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গত বছরের ১৭ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বাতিল হয়ে যায় এবং প্রায় দেড় লাখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

আইএমই/এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!