চট্টগ্রামের ছাত্রলীগে ইমু-দস্তগীর একঘরে, উপেক্ষার জবাব দিচ্ছেন অভিমানী নেতারা

ক্ষোভ ও হতাশায় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের বেশিরভাগই নেতাই এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। এই নেতারা সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকায় বর্তমানে কার্যত একঘরে হয়ে পড়েছেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। ছাত্রলীগ আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশেও বর্তমান কমিটির ৮-১০ জন নেতা ছাড়া আর কেউই শীর্ষ দুই নেতার ছায়া মাড়াতে নারাজ। আ জ ম নাছির ও মহিউদ্দিন চৌধুরী বলয়ের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ইস্যুতে মতদ্বৈততা দেখা গেলেও ইমু-দস্তগীরের ওপর ক্ষোভ রয়েছে দুই বলয়েই।

নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বৈর মনোভাব ও ‘ঘাড় ত্যাড়ামি’র জন্য ইমু-দস্তগীর একঘরে হয়ে গেছেন— এমনটিই দাবি করছেন মহানগর ছাত্রলীগের পদধারী বেশিরভাগ নেতাই। মহানগর ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক আয়োজনগুলোতে দেখা যাচ্ছে এর প্রতিফলন।

দেখা গেছে, বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে নগর ছাত্রলীগে প্রায় ৩০০ জন নেতা থাকলেও ইমু-দস্তগীরের পাশে দেখা যায় হাতেগোনা ৮-১০ জনকে। অন্য নেতারা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে স্পষ্টত এড়িয়েই চলছেন।

ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ ঘোষণা করে কমিটি বাতিলের দাবিতে একাধিকবার মিছিল সমাবেশ করতে দেখা গেছে আ জ ম নাছির বলয়ের ছাত্রলীগ নেতাদের। এবার সেই দাবিতে সরাসরি সমাবেশ না করলেও মুখ খুলতে শুরু করেছেন মহিউদ্দীন চৌধুরী বলয়ের ছাত্রনেতারাও।

বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) মহানগর ছাত্রলীগের উদ্যোগে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবিতে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। নগর ছাত্রলীগের পদধারী মাত্র ৭-৮ জন নেতার দেখা মিলেছে সেই মিছিলে। অথচ মহানগর ছাত্রলীগের পদধারী নেতার সংখ্যা ২৯১ জন।

শুধু বুধবারের আয়োজনই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নগর ছাত্রলীগ আয়োজিত বেশকিছু অনুষ্ঠানেও দেখা গেছে একই চিত্র। ১৫ আগস্ট শোক দিবস, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে নগর ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানেও সেই ৮-১০ জন ছাড়া সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পাশে বাকি নেতাদের দেখা যায়নি। তবে ভিন্ন আয়োজনে শোক দিবস কিংবা গ্রেনেড হামলা দিবসের মতো অনুষ্ঠান ঠিকই পালন করেছেন এই নেতারা।

চট্টগ্রাম নগরীতে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে ইমু-দস্তগীরের স্বৈর আচরণ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মূলত সেই ক্ষোভ থেকে এই দুই নেতার ছায়াও মাড়াতে চাইছেন না মহানগর কমিটির বেশিরভাগ নেতাই।

নগর ছাত্রলীগের নেতারা অভিযোগ করেন, কমিটি নিয়ে নগর ছাত্রলীগের অন্য কোনো নেতার সাথে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কমিটি দিয়ে নিজেদের কপাল নিজেরা পুড়িয়েছেন ইমু-দস্তগীর। নিজেদের কর্মীদের নেতা বানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র ও ডেকোরাম নষ্ট করার অভিযোগও তোলা হয় এই দুই নেতার বিরুদ্ধে।

নগর ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি তালেব আলীকে আগে যে কোনো অনুষ্ঠানে তার কর্মীদের নিয়ে উপস্থিত থাকতে দেখা গেলেও ইদানিং নগর ছাত্রলীগের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায় না। কেন হঠাৎ এই অনীহা— এমন প্রশ্নের জবাবে তালেব আলী ‘করোনার প্রভাব ও ব্যক্তিগত কারণ’ দেখালেও পরবর্তীতে ঠিকই স্বীকার করে নেন, ইমু-দস্তগীরের স্বৈরাচারী মনোভাব এজন্য দায়ী। তিনি বলেন, ‘ইমু-দস্তগীর সমন্বয়হীনভাবে কাজ করলে বাকিরা কেন যাবে?’

ইমু-দস্তগীরের দাম্ভিকতার জন্য অনেক সিনিয়র নেতাদের সাথে তাদের মতবিরোধ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মতবিরোধ মিটিয়ে নিতে একাধিকবার চেষ্টাও করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল আসেনি।

নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৌমেন বড়ুয়াও ইমু-দস্তগীরের স্বৈর মনোভাবকে দায়ী করে বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগের বেশিরভাগ নেতাই ইমু-দস্তগীরের কাছ থেকে দূরে থাকাটাই ভালো মনে করছেন।’

নগর ছাত্রলীগের থানা-ওয়ার্ডের কমিটি নিয়ে নজিরবিহীন অনিয়মের কথা উল্লেখ করে সৌমেন বড়ুয়া বলেন, ‘নুরুল আজিম রনি সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় যে কমিটিগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো মোটামুটি সব নেতাদের নিয়ে করা হয়েছে। সেখানে একটা সমন্বয় ছিল। কিন্তু ইমু-দস্তগীর সেসবের কিছু তোয়াক্কা না করেই নিজেদের মাই ম্যানকে নেতা বানিয়ে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘নগর ছাত্রলীগের প্রায় সব নেতার আপত্তির পরও ইমু-দস্তগীর ঘাড় ত্যাড়ামি করে ডবলমুরিং থানা কমিটি দিয়েছে। সেই কমিটি গঠনে অনিয়ম নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটি করলেও সেই তদন্ত রিপোর্ট আর কখনও প্রকাশ পায়নি।’

এর আগে ইমু-দস্তগীরের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অনাস্থা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন বর্তমান কমিটির ৪৬ জন পদধারী নেতা। এছাড়াও ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ বলে দাবি করে মিছিল সমাবেশও করা হয়েছে বহুবার।

সংগঠনের স্বার্থে নিজেদের বলয়ের নেতাদের বিপক্ষে প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমু-দস্তগীরের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন সহ-সভাপতি ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদার একাধিক নেতাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বলেন, তাদের নামে কেউ কোনো অভিযোগ করলেই তারা গ্রুপ লিডারের কাছে গিয়ে বিচার দেন। তারা সব সময় গ্রুপ লিডারের কাছাকাছি থাকেন। আমাদের নামে কানভারি করেন। তবে তারা যে একক ক্ষমতা দেখিয়ে কমিটি দিচ্ছে, তাতে অধিকাংশ নেতাই নাখোশ। তবে কেউ সাহস করে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারছেনা গ্রুপের স্বার্থে।’

নগর ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতি বলেন, ‘ইমু-দস্তগীরের নামে এতো বেশি অভিযোগ যে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব বুঝতেছি না। তারা মনে করে শুধু তারাই রাজনীতি করে আর আমরা কলা বিক্রি করি। তাদের কর্মীদের নেতা হওয়ার অধিকার আছে, আর আমাদের কর্মীদের নেই। সবকিছু মিলিয়ে মূলত হতাশা ও ক্ষোভে তাদের আর কোনো প্রোগ্রামে যাই না।’

২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর কাউন্সিলবিহীন সিলেকশানের মাধ্যমে ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তার কিছুদিন পর ২৯১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসে কেন্দ্র থেকে।

মাত্র দুই বছরের জন্য গঠন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সেই কমিটি। কিন্তু সেই নগর ছাত্রলীগের বয়স এখন দশকের দ্বারপ্রান্তে। দুই বছরের অনুমোদিত সেই ছাত্রলীগের ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক ছাত্রনেতাই বিবাহিত, বাকিরা চাকরি ও ব্যবসার সাথে যুক্ত। অন্যদিকে হাতেগোনা দু-চারজন ছাড়া ছাত্রত্ব নেই কারোরই।

অন্যদিকে নগর কমিটি বিলুপ্ত হবে— এমন খবর পেয়ে চট্টগ্রাম নগরের ওয়ার্ড, থানা ও কলেজ ইউনিট মিলিয়ে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি একদিনেই রেকর্ডসংখ্যক ১৩টি ইউনিটের কমিটি অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন এলাকার দাগী সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং লিডারও এসব কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। এমন কাণ্ডের জন্য নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু এবং সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে দায়ী করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন কারণে সমালোচনায় থাকা নগর ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদের শেষ পর্যায়ে অনুমোদন দেওয়া এসব কমিটিতে কোন নিয়ম নীতি না মেনে অছাত্র, প্রশাসনের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ উঠছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে পাশাপাশি কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন মহানগর ছাত্রলীগের পদে থাকা নেতারাও।

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে ফোন করা হলেও তাদের সাড়া মেলেনি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!