চট্টগ্রামের রাজনীতিতে বাড়ছে উত্তাপ, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে মাঠে হেফাজতও

কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে সাংগঠনিক কর্মসূচির মধ্যদিয়ে তৈরি হচ্ছে নির্বাচনের জন্য। চট্টগ্রামের রাজনীতিতেও বইছে একই হাওয়া। এতদিন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও এবার বিএনপি-জামায়াতও রাজনীতির মাঠে নামছে। এরমধ্যে নগরীতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। একইসঙ্গে ইসলামী সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ নেমে পড়েছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশে।

চট্টগ্রাম নগরীর রাজনীতিতে ধীরে ধীরে উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে। এরমধ্যে কয়েকটি ঘটনায় তা আঁচ করতে পারছে নগরবাসী। বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) চট্টগ্রাম কলেজ মাঠে শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবরে চকবাজার ও কলেজ ক্যাস্পাসে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ।

এর আগে চট্টগ্রামের ১০ আসনের উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে প্রকাশ্যে হামলা চালায় দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকা বিএনপি। বুধবারের (১৯ জুলাই) সেই হামলার বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ঝেরে কথা বলতেও শোনা গেছে।

বুধবারের ওই ঘটনায় বিএনপির বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা যায়নি ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাদের। তবে ঘটনার ঘণ্টা দেড়েক পর তারা গিয়ে বিএনপির কাজির দেউরির কার্যালয় নসিমন ভবনে হামলা ও রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করে। এর আগে গত ১৪ জুনও জামালখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও বিভিন্ন ছবি ভাঙচুর করে বিএনপির নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রামে এতদিন ধরে কোণঘেষাঁ ছিল বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী সব প্রতিপক্ষ। তবে নির্বাচন ঘিরে ধীরে ধীরে সামনে আসতে শুরু করেছে এতদিন ঝিমিয়ে থাকা এসব সংগঠন। ইতোমধ্যে বিএনপির হামলার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ। এক দফা মুখোমুখি হলেও আগামীতে রাজনীতির মাঠে তাদের আরও উত্তাপ বাড়বে বিরোধী প্রতিপক্ষদের সঙ্গে।

আন্দোলন আরও তীব্র করবে বিএনপি

যতদিন নিরেপক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না, ততদিন নির্বাচনে যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় দলটি। এজন্য আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করা হবে দলটির পক্ষ থেকে। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।

এই বিষয়ে নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। আমাদের রাজপথ থেকে কেউ সরাতে পারবে না।’

বিএনপির কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এটি নিঃসন্দেহে ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই ঘটনায় এখনও পুলিশ কোনো মামলা নিচ্ছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে মামলা না নিলে আমরা আদালতে মামলা করবো।’

ঘুম ভেঙেছে জামায়াতের

বিএনপির পাশাপাশি ‘কুম্ভকর্ণের ঘুম’ থেকে জেগেছেন জামায়াতের নেতারা। দীর্ঘ সময় বিরতির পর ফের রাজনীতির মাঠে ফিরতে চায় দলটি। এজন্য নগরীর লালদীঘিতে সমাবেশ করতে ইতোমধ্যে দু’দফা পুলিশ কমিশনার বরাবর অনুমতিপত্র নিয়ে গেলেও পুলিশের সায় মিলেনি একবারও।

শনিবার (২২ জুলাই) তাদের সমাবেশ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে পরবর্তীতে কখন সমাবেশ করা হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি দলটি।

জামায়াতের চট্টগ্রাম মহানগরের নায়েবে আমীর ও মজলিশে সূরার সদস্য আ জ ম ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিকভাবেই এগোবো। পুলিশ না করেছে, আমরা আমাদের মতো করে কাজ করবো। আমরা নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে কাজ করেছি অতীতে। তাই এবারও বিশৃঙ্খলা হয় এমন কিছু করবো না।’

তবে সমাবেশের বিষয়ে নেতৃবৃন্দ বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।

রাজনীতির মাঠে হেফাজতও

রাজনৈতিক দল না হয়েও রাজনীতির মাঠে থাকতে চায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন সময়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন, করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনাও।

বিনা কারণে নিজ দলের কর্মীদের গ্রেপ্তার, রিমান্ডে অত্যাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরব সংগঠনটির নেতারা।

সম্প্রতি হেফাজতের সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজাহার এক বক্তব্যে শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে সর্বশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমন নিয়ে ঘটা সহিংস ঘটনায় পুলিশ ও সরকারের বিষোদগার করেন। রিমান্ডের নামে সরকারি বাহিনীর নির্মম অত্যাচারেরও সমালোচনা করেন হেফাজতের এই নেতা।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম সরকারের পক্ষে না, বিপক্ষেও না। আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য যদি সেনাবাহিনী নামাতে হয় তাতেও আপত্তি নেই।’

হেফাজতের সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক মুফতি হারুন ইজাহারের বক্তব্যর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওনার বক্তব্য ওনার বিষয়। তবে আমরাও নিরপরাধ আলেম-ওলামাদের গণহারে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাই। তবে যারা অপরাধী তাদের বিচার দেশের প্রচলিত আইনে হোক, আমি সেটাই চাই।’

হেফাজত কি সরকারবিরোধী সংগঠন—এমন প্রশ্নের জবাবে রুহি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। আমরা কাউকে ক্ষমতায় নামানোর বা ক্ষমতায় বসানোর সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতে চাই না। আমরা আমাদের নীতি দ্বারা চলবো।’

আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী চাপ
এতদিন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ একা আধিপত্য চালালেও এখন তাদের প্রতিপক্ষ নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। গত ১৯ জুলাই নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলার পর নড়েচড়ে বসেছে সংগঠনটি। বিএনপি ছাড়াও জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গেও রাজনীতির মাঠে লড়তে হবে তাদের। আর এজন্য তারা প্রস্তুতও এবং প্রতিপক্ষকে ‘শক্ত হাতে’ দমনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত—ত্রিমুখী এই চাপ কিভাবে সামলাবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জন্মের পর থেকেই সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা সংগঠন। এই রকম মূহুর্ত আগেও অনেকবার মোকাবিলার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। তবে বিএনপি আমাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে যে হামলাটা করেছে, ওটা কাপুরুষতার লক্ষণ। আমরা ওদের সুযোগ দিয়েছি বিধায় ওরা এখনও রাজপথে আছে। আমরা চাই ওরা রাজনৈতিকভাবে বিষয়গুলো মোকাবিলা করুক। কিন্তু তারা যদি জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করে, তবে আমরা বসে থাকবো না।’

নগর আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক আরও বলেন, ‘এক-এগারোর সরকারের পর থেকেই ওরা সহিংস আন্দোলনে জড়িয়েছে। আবারো তারা পুরাতন রূপে ফিরে যাচ্ছে। ওরা মনে করেছে আমেরিকাসহ বিদেশি সংগঠনগুলো দেশে এসে ওদের হয়ে কথা বলবে। কিন্তু তারা কিছু না বলাতে বিএনপির নেতাদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তারা সহিংস পথ বেছে নিচ্ছে।’

জামায়াত ও হেফাজতের বিষয়ে আ জ ম নাছির বলেন, ‘ওরা সকলেই এক ও অভিন্ন। তাদের উদ্দেশ্যই নাশকতা করা। আর নাশকতার জবাব কিভাবে দিতে হয় তা আওয়ামী লীগের থেকে ভালো কেউ জানে না।’

তবে নগরীর রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে সার্বক্ষণিক মাঠে আছে পুলিশ। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশের উপস্থিতির সংখ্যা। সাদা পোশাকে পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা দলও কাজ করছে, এমনটা জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার নোবেল চাকমা।

নোবেল চাকমা বলেন, ‘বুধবার (১৯ জুলাই) যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে ভবিষ্যতে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য মাঠে কাজ করছি আমরা। সাদা পোশাকের পুলিশ সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!