চট্টগ্রামের পূজায় হামলার নেপথ্য-নায়করা চিহ্নিত, চেনামুখও লুকিয়ে ছিল মিছিলে

ঘটনার পর উস্কানি ছড়ান চসিক কাউন্সিলর

চট্টগ্রাম নগরীর মোমিন রোড এলাকার জেএমসেন হলে দুর্গাপূজার গেট ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িতদের খুঁজতে নগর পুলিশের সঙ্গে মাঠে নেমে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। তারা এই ঘটনায় এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও নেপথ্য নায়কদের মধ্যে অনেককে চিহ্নিত করতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা ইতিমধ্যে পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকাও দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে এর পাশাপাশি ঘটনার দিন উস্কানিমূলক ভূমিকা রাখা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সনাতনধর্মাবলম্বী এক কাউন্সিলরের গতিবিধিও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। জেএমসেন হলে দুর্গাপূজা মণ্ডপে আকস্মিক হামলার ঘটনা দ্রুততার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হলেও এরপর প্রশাসনকে নিয়ে ওই কাউন্সিলরের বিতর্কিত বক্তব্যে বিব্রত খোদ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারনী মহল। ঘটনার দিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে হিন্দু নেতাদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ না থাকলেও ওই কাউন্সিলর উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছে সনাতনী সমাজকে— এমন অভিযোগ সামনে রেখে ওই কাউন্সিলরের ভূমিকা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা এমনটিই জানা গেছে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে। এছাড়া ঘটনার পর তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে দ্বিমত করা চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের দুজন নেতার ওপরও মারমুখী ছিলেন ওই কাউন্সিলর— এমন অভিযোগও মিলেছে।

চেনামুখও ছিল ঝটিকা মিছিলে

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, জেএমসেন হলের দুর্গাপূজা মণ্ডপে আকস্মিক হামলার পরিকল্পনায় কারা জড়িত, কারা ছিলেন নেতৃত্বে, বিক্ষোভে হঠাৎ শ্লোগান দিয়ে মিছিল ও হামলা করল কারা, পূজা কমিটির বিরোধ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সঙ্গে পূজা কমিটির সমন্বয়হীনতাসহ সম্ভাব্য সব বিষয়কে সামনে রেখে ঘটনাটির তদন্ত করছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এর পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের অবস্থান এবং রাজনীতিবিদদের ভূমিকাও।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ গেইটে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক ‘কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ’ জানিয়ে সমাবেশ করে।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ গেইটে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক ‘কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ’ জানিয়ে সমাবেশ করে।

জেএমসেন হলের ওই হামলার পর তথ্যনুসন্ধান ও আটককৃতদের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় একজন নেতাকেও হামলাকারীদের মিছিলে দেখা গেছে। এছাড়া ঘটনার আগে কয়েকজন মিলে হামলার এই পরিকল্পনার ছকও তৈরি করেন ওই নেতা। সিআরবির হাসপাতালবিরোধী আন্দোলনেও ওই নেতাকে সরব দেখা গেছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। অন্যদিকে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গেও তার সখ্য রয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে তার পরিচয় ও ভূমিকাও এর মধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে। খুব শীঘ্রই তাকে গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান চালাতে পারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কী ঘটেছিল ১৬ অক্টোবর?

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে জুমার নামাজের একটি মিছিল থেকে ঐতিহাসিক জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে গেটে হামলা হয়। হিন্দু সম্প্রদায় ওই পূজামণ্ডপের গেট ভাঙচুর করা হয়েছে বলে দাবি করলেও মাঠপর্যায়ে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজে মূলত গেটের ব্যানার ও কাপড় ছেঁড়ার চিত্রই ধরা পড়েছে।

নিউমার্কেট এলাকার আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরও হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল তুলসীধামের মন্দির এবং নন্দনকানন লোকনাথ মন্দির হয়ে আন্দরকিল্লায় আসার চেষ্টা করে।
নিউমার্কেট এলাকার আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরও হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল তুলসীধামের মন্দির এবং নন্দনকানন লোকনাথ মন্দির হয়ে আন্দরকিল্লায় আসার চেষ্টা করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিন দুপুরে জুমার নামাজ শেষে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ গেইটে ৫০০ থেকে ৭০০ লোক ‘কুমিল্লার ঘটনার প্রতিবাদ’ জানিয়ে সমাবেশ করে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে নিউমার্কেট এলাকার আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরও হাজারখানেক লোকের একটি মিছিল তুলসীধামের মন্দির এবং নন্দনকানন লোকনাথ মন্দির হয়ে আন্দরকিল্লায় আসার চেষ্টা করে। এ সময় মিছিলটি কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার ও ওসির নেতৃত্বে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে নন্দনকানন বোস ব্রাদার্স মোড়ে। এরপর মিছিলটি সিনেমা প্যালেস হয়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে এসে বিক্ষোভে মিলিত হয়।

সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে জেএমসেন হলের দিকে এগিয়ে যায়। শুরুতেই তারা আন্দরকিল্লা মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর মধ্যে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে মিছিলটি। এর মধ্যে একটি গ্রুপ সিরাজদ্দৌল্লা সড়কে, একটি গ্রুপ রেডক্রিসেন্ট গলিতে এবং অপর গ্রুপটি মসজিদে ঢুকে পড়ে। তবে এই ফাঁকে শ’খানেক লোক চলে যায় চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে। এই গ্রুপটিই মূলত জেএমসেন হলের তোরণের ব্যানার ও কাপড় ছিঁড়ে নেয় এবং মন্দিরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও পরে টিয়ারশেল ছুঁড়ে হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

ফাঁকে শ’খানেক লোক চলে যায় চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে। এই গ্রুপটিই মূলত জেএমসেন হলের তোরণের ব্যানার ও কাপড় ছিঁড়ে নেয় এবং মন্দিরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।
ফাঁকে শ’খানেক লোক চলে যায় চেরাগি পাহাড় মোড়ের দিকে। এই গ্রুপটিই মূলত জেএমসেন হলের তোরণের ব্যানার ও কাপড় ছিঁড়ে নেয় এবং মন্দিরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে।

এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন নিজেও ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে ৭৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

মিছিলের টার্গেট ছিল তুলসীধামও

তবে ওই মিছিল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া অনেকেই পুলিশকে প্রাথমিকভাবে দেওয়া তথ্যে জানিয়েছে, সেখানে শুধুই সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। কোন মিছিল করা হবে না— এটি আগেই নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই ৪-৫ জন অতর্কিত শ্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ওই ৪-৫ জনই চট্টগ্রামের পরিবেশ আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যে ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় সম্পৃক্ত ছিল বলেও তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। সেদিনের মিছিলে হেফাজতে ইসলামসহ জামায়াত ও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় নেতাকর্মীদেরও অংশগ্রহণ ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

হামলার পর জেএমসেন হলের সম্মুখভাগ
হামলার পর জেএমসেন হলের সম্মুখভাগ

এদিকে ওই ঘটনার পরই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ভিন্ন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। মূলত ওই কাউন্সিলরের চাপেই নিরাপত্তা না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জন না দেওয়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা। এরপর পুলিশ ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরসহ রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাসে রাত ৮টার দিকে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়।

তবে নিউমার্কেট এলাকার আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা থেকে আরও হাজারখানেক লোক জড়ো হয়ে মিছিলের কোনো আগাম তথ্য ছিল না প্রশাসনের কাছে। আগাম তথ্য না থাকায় মিছিলটি নিয়ন্ত্রণে নিতে একটু বাড়তি চাপে পড়ে পুলিশও। খবর পেয়ে আন্দরকিল্লা থেকে কোতোয়ালী জোনের এসি ও থানার ওসি দ্রুতই চলে গিয়ে নন্দনকানন বোস ব্রাদার্সের মোড়ে অবস্থান নেন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আমতল, গোলাম রসুল মার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকা আসা মিছিলটির টার্গেট ছিল তুলসীধাম কিংবা সনাতন সম্প্রদায়ের অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!