চকরিয়া ভূমি অফিসে জালিয়াতি, সাবেক সার্ভেয়ার মশিউর ও সেলিমের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে

কক্সবাজারের চকরিয়ার ভূমি কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে খতিয়ান সৃজন, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

অভিযুক্তরা হলেন চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার (ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) সেলিম উল্লাহ ও চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার (বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর চান্দগাঁও সার্কেল ভূমি অফিসে কমর্রত) মশিউর রহমান।

তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য একটি চিঠি ১২ ডিসেম্বর চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর মনজুর আলম।

সংশি­ষ্ট সূত্রে জানা যায়, চকরিয়া পৌরসভার দক্ষিণ বাটাখালী এলাকায় দারুল কোরআন একাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য খতিয়ান করতে আবদেনকৃত একই জমি জালিয়াতির মাধ্যমে দুজনের নামে প্রতিবেদন দিয়েছেন দুই কর্মকর্তা। এছাড়া ফাইল আটকে ঘুষ দাবি এবং জালিয়াতির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ভূমি অফিসের বালাম বই থেকে পাতা ছিঁড়ে ফেলার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে তহসিলদার সেলিম উল্লাহ ও চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে সার্ভেয়ার মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে। শুধু ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানই নয়, এভাবে জালিয়াতি ও ঘুষ গ্রহণের একাধিক অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সেলিম উল্লাহ চিরিঙ্গা ভূমি অফিসে যোগদান করার পর থেকেই চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মশিউর রহমানের যোগসাজশে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। সেখানে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার পরও কাজ হতো না। সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করতে তাদের নথিপত্র পর্যন্ত গায়েব করে দিতেন তহসিলদার সেলিম উল্লাহ ও সার্ভেয়ার মশিউর রহমান। জাল দলিলে জমির নামজারি হয়ে যেত অন্যের নামে। নামজারি, খারিজ, খাজনা প্রদানসহ অন্যান্য কাজে চরম ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ। কামাল ও ইকবাল নামের দুই দালালের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট করে ঘুষ-দুর্নীতির বাজার বসে চিরিঙ্গা ভূমি অফিসে। তার এসব অবৈধ কাজের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে সার্ভেয়ার মশিউর রহমান।

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে চিরিঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার সেলিম উল্লাহ ও চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে সার্ভেয়ার মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। পরে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

৮ মাসে একই জমি নিয়ে দুই রকম প্রতিবেদন

চকরিয়া উপজেলার পহরচাঁদা মৌজার নাসির উদ্দিন হায়দার নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, তিনি ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল ও ৯ মে রেজিস্ট্রি কবলামূলে স্থানীয় সৈয়দ আহমদ ও আহমদ হোসেন থেকে ৬৬ শতক জমি কেনেন। ভোগদখল থাকা অবস্থায় তার নামে ১৯৬০ নম্বর খতিয়ান সৃজিত হয়। সেই খতিয়ানের বিরুদ্ধে পেকুয়ার নুরুল কবির গং ৩১/২২২৩ মামলা দায়ের করলে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) সরেজমিন তদন্তের জন্য সার্ভেয়ার মশিউর রহমান ও হারবাং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আ ন ম ইদ্রিস আজাদকে নির্দেশ দেন। হারবাং ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর এবং সার্ভেয়ার মশিউর রহমান ২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি পৃথক পৃথক প্রতিবেদন নালিশি জমির স্বত্ব ও দখল নামজারিকারক নাসির উদ্দিন হায়দারের বলে উল্লেখ করেন।

জানা গেছে, এই দুই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) মো. রাহাত উজ জামান নাসির উদ্দন হায়দারের নামে সৃজিত ১৯৬০ নম্বর খতিয়ান বহাল রেখে বাদি নুরুল কবির গংয়ের আপত্তি খারিজ করে দেন। এসি ল্যান্ড আদেশে লিখেন, আপত্তিকারীর আপত্তির প্রেক্ষিতে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, হারবাং ও সার্ভেয়ার পৃথক পৃথক প্রতিবেদন দাখিল করেন। উল্লেখিত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সৃজিত ১৯৬০ নম্বর খতিয়ানভুক্ত বিএস ৯৭৮ দাগের ০.৬৬ একর জমিতে নামজারিকারীর (নাসির উদ্দিন হায়দার) স্বত্ব ও দখল সঠিক রয়েছে।

এরপর গত ১১ জুন বাদিপক্ষ কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবরে রিভিশন (আপিল) মামলা (নম্বর ১৩/২০২৩) দায়ের করে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (এসি ল্যান্ড) পুনরায় সরেজমিন তদন্তপূর্বক দখল ও স্বত্ত্ব বিষয়ে আপিলকারী ও প্রতিবাদীর দখলীয় জমি আলাদা কালিতে চিহ্নিত করে স্ক্র্যাচ ম্যাপসহ সুষ্পষ্ট মতামত দিতে বলেন।

এদিকে এসি ল্যান্ড এ বিষয়ে সরেজমিন তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আবারও সার্ভেয়ার মশিউর রহমানকে নির্দেশ দেন। গত ৯ আগস্ট সরেজমিন তদন্তের জন্য নোটিশ দিলেও তখন পহরচাঁদা মৌজায় বন্যা থাকায় সার্ভেয়ার সেখানে যাননি। পরবর্তীতে প্রতিবাদী নাসির উদ্দিন হায়দারকে কোনো নোটিশ না দিয়ে সরেজমিন তদন্ত ছাড়াই সার্ভেয়ার মশিউর রহমান গত ৩ সেপ্টেম্বর একটি বানোয়াট প্রতিবেদন দাখিল করেন যা গত ৯ জানুয়ারি তার দেওয়া প্রতিবেদনের বিপরীত।

নাসির উদ্দিন হায়দার অভিযোগ করে বলেন, বন্যার প্রকোপ কমলে তিনি গত ২৪ আগস্ট চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে সার্ভেয়ার মশিউর রহমানের সাথে দেখা করে সরেজমিন তদন্ত বিষয়ে জানতে চান। তখন সার্ভেয়ার তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে বলেন, টাকা দিলে তিনি সরেজমিন তদন্তের জন্য যাবেন। এর এক সপ্তাহ পর সার্ভেয়ার মশিউর রহমান বাদিপক্ষ থেকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবরে একটি মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে সার্ভেয়ার মশিউর রহমান উল্লেখ করেন নালিশী জমি ৫০ বছর ধরে বাদিপক্ষের দখলে আছে এবং নাসির উদ্দিন হায়দার কেনার পর বিরোধের কারণে কিছু জমি পরিত্যক্ত পড়ে আছে। অথচ এর ৮ মাস আগে ওই একই সার্ভেয়ার মশিউর রহমান তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, নামজারিকারীর (নাসির উদ্দিন হায়দার) স্বত্ব ও দখল সঠিক রয়েছে।

এ বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সাবেক সার্ভেয়ার (বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর চান্দগাঁও সার্কেল ভূমি অফিসে কমর্রত) মশিউর রহমানকে প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘জালিয়াতি হয়ে থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নিবে। আর না হলে তো সমস্যা নেই। মূলত আমার কারণে চকরিয়ায় আমিন ও মনসুর অবৈধ কাজ করতে পারে নাই। তাই তারা মিথ্যা অভিযোগ দিছে। চকরিয়ার ভূমি ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে আমিন ও মনসুর।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!