গতি ফিরছে ইন্দ্রপুলের লবণশিল্পে, স্বস্তিতে ব্যবসায়ীরা

সরকারি নানা ইতিবাচক পদক্ষেপের সুফলের সাথে দীর্ঘদিন পর আবারও গতিশীল হয়েছে চট্টগ্রামের পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী লবণ শিল্প। এ নিয়ে স্বস্তিতে আছেন ইন্দ্রপোলের লবণ ব্যবসায়ীরা। লবণমিলকে কেন্দ্র করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ১০/১২ হাজার শ্রমিকরা এখানে এসে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বছরের ৬ মাস এখানে পুরোদমে চলে লবণ পরিশোধনের কাজ।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, উখিয়া, মগনামা এলাকায় মাঠে উৎপাদিত কাঁচা লবণ আসতো পটিয়ার ইন্দ্রপুল এলাকার লবণ মিলগুলোতে। সাঙ্গু নদী থেকে মুরালী ঘাট হয়ে চাঁনখালী খাল বেয়ে লবণ বোঝাই বড় বড় নৌকা আসতো ইন্দ্রপুলে। কিন্তু ৯০ দশকের পর থেকে চাঁনখালী ভরাট হয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে ইন্দ্রপুল লবণ শিল্প। চাঁনখালী ভরাট হয়ে যাওয়ার পরেও কর্ণফুলী নদী দিয়ে বোয়ালখালী খাল হয়ে ইন্দ্রপুলে লবণ বোঝাই ট্রলার আসতো। কিন্তু ধলঘাট এলাকার চন্দ্রকলা সেতু ভেঙ্গে খালে আবার প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।

কিন্তু পরবর্তীতে চাঁনখালী খাল খনন হলেও নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে এ শিল্পটি। এ সময় ধীরে ধীরে অনেক লবণ মিল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১শ লবণ মিল থেকে ডজনে নেমে আসে। পরে ট্রাকে করে লবণ আসতে থাকে ইন্দ্রপুলে। গত কয়েক বছর থেকে সরকারি নানা ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে ইন্দ্রপুলের লবণ মিলগুলোতে আবারো কাঁচা লবণ আসতে শুরু করে। বর্তমানে ট্রলার ও ট্রাকে করে কাঁচা লবণ এখানে আসে।

লবণ শোধনের কাজে ব্যস্ত শ্রমিক।
লবণ শোধনের কাজে ব্যস্ত শ্রমিক।

বৃটিশ আমল থেকে চাঁনখালী খালের পাড়ে গড়ে উঠা দেশের অন্যতম বৃহৎ লবণ পরিশোধন এলাকা ইন্দ্রপুল থেকে পরিশোধিত লবণ যাচ্ছে সারা বাংলাদেশে।

বর্তমানে ইন্দ্রপুল এলাকায় প্রায় ৪৮টি লবণ মিল রয়েছে। যেখানে বিগত কয়েক বছর আগেও ২০টি মিলও ভালোভাবে চলতো না। কিন্তু এখন পুরোদমে চলছে লবণ পরিশোধের কাজ। চাঁনখালী খাল হয়ে ট্রলারে করে এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে ট্রাকে করে লবণের কাঁচামাল আসে পটিয়ায়। আবার পটিয়া থেকে যেসব লবণ সারা দেশে যাচ্ছে তা দেশের ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটাচ্ছে বলে জানা যায়।

ট্রলার মালিক মো. কবির আহাম্মদ সওদাগর বলেন, ‘তিনি নিয়মিত কুতুবদিয়া থেকে লবণের কাঁচামাল নিয়ে পটিয়ার ইন্দ্রপুলে আসেন। তার ট্রলারে সর্বোচ্চ ২ হাজার মন লবণ কাঁচামাল আনা যায়। মিলে বর্তমানে ২ শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক লবণ পরিশোধনের কাজে নিয়োজিত। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে যেসব কাঁচামাল ট্রাকে এবং ট্রলারে করে আনা হয় তা শ্রমিকরা বস্তা এবং ঝুঁড়ি করে মিলে নিয়ে যায়। কাঁচামালগুলো মিলে পরিশোধন করে এবং প্যাকেটজাত করে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়।’

ইসলামাবাদ সল্টের পরিচালক মুহাম্মদ আশেক এলাহি বলেন, ‘ইন্দ্রপুলের মিলে পরিশোধিত লবণ প্যাকেটজাত করে সিলেট, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ভৈরব, নরসিংদী, নোয়াখালীসহ আরো অনেক জেলায় সরবরাহ করা হয়। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে লবণ শিল্প সঠিক পথেই এগুচ্ছে।’

কথা হলে কয়েকজন শ্রমিক জানান, তারা ভোলা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ইন্দ্রপুলে শ্রমিকের কাজে নিয়োজিত প্রায় ৫ বছর ধরে। প্রত্যেক মিলে অন্তত ২ শতাধিকের অধিক শ্রমিক রয়েছে। ইন্দ্রপুল এলাকায় যেসব মিল রয়েছে এসব মিলে ১০/১২ হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য একটি সমিতিও রয়েছে বলে তারা জানান।

বিসিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ লক্ষ মেট্রিকটন লবণ উৎপাদন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে লবণের চাহিদা রয়েছে ১৬ লক্ষ ২৫ হাজার মেট্রিকটন। এতে আরও ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিকটন লবণের ঘাটতি রয়েছে। তাই আপদকালীন মজুতসহ প্রায় ৩ লাখ মেট্রিকটন লবণের প্রয়োজন রয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিকটন লবণের আমদানির প্রয়োজন রয়েছে।

অন্য একটি সূত্র জানায়, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন কলকারখানায় শিল্প লবণ হিসেবে সোডিয়াম সালফাইড আমদানি করে থাকে। তা ধবধবে সাদা বিধায় ভোজ্য লবণ হিসেবে বিক্রি করে আসছে। অন্যদিকে সোডিয়াম সালফাইড নামে বস্তার গায়ে লেভেল লিখে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানি করে লাভবান হচ্ছে। কারণ সোডিয়াম সালফাইড আমদানিতে সরকারকে ৭% ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানিতে শতভাগ ট্যাক্স দিতে হয়। তাই তারা ৭% ট্যাক্স দিয়ে প্রতারণা করে ভোজ্য লবণ আমদানিতে ব্যয় কম হচ্ছে এবং অধিক মুনাফা লাভের সুযোগ পাচ্ছে। এতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী লাভবান হলেও অধিকাংশ লবণ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সরকারি নজরদারি বাড়ানোর কারণে অসাধু ব্যবসায়ীদের সোডিয়াম সালফাইড আমদানি কমেছে। এছাড়াও চাঁনখালী খাল খনন, মহাসড়কের যান চলাচলে হয়রানি বন্ধসহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ কারণে বর্তমানে পটিয়া ইন্দ্রপুলে নতুন নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে।

পটিয়া ইন্দ্রপুল লবণ শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আবদুল খালেক বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ইন্দ্রপুল লবণ শিল্প থেকে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু বর্তমানে সরকারের বেশ কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে এখানে নতুন করে লবণ শিল্পের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-মহাসড়ক সম্প্রসারণ, লবণ বোঝাই ট্রাক হয়রানি বন্ধ, চাঁনখালী খাল খনন করায় সহজে ট্রলার চলাচল করা। এছাড়াও এখানে লবণ শিল্পের প্রসারে বিসিক শিল্প নগরীর প্রতিনিধি সবসময় তাদের সহায়তা করেন।’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!