কালান্তরের ভাবনায় আগস্ট আবছায়া

ইতিহাস বারে বারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে মানুষের ভালোবাসার শক্তি সীমিত আর নৃশংসতার ও পাশবিকতার শক্তি সীমাহীন। নৃশংস হত্যাকান্ডগুলো সে কথাই পুনরায় মনে করিয়ে দেয়। ক্ষমতা, মোহের বিকৃত রূপের কাছে ভালোবাসার পরাজয় নতুন কিছু নয়। কোন মানুষ যখন সত্য, ন্যায়, স্বাধীনতা, গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিতার জন্য জীবনবাজী রেখে নেতৃত্ব দেয়; তখন সে হয়ে ওঠে সাধারনের মাঝে অসাধারণ। গণমানুষের নেতা, আস্থার স্থল।বঙ্গবন্ধুর তাঁদেরই একজন। আবার কিছু মানুষ সবসময় এর বিপরীত গলিতে হাঁটে, ষড়যন্ত্রের লিপ্ত হয়ে নিজেদের খলনায়ক, দেশদ্রোহী হিসেবে পরিচয় করে দেয়। এ দু’ধরনের মানুষকে সহজে চেনা যায়। আবার তৃতীয় শ্রেণির মানুষকে সহজে চেনা যায় না। এরা লোভী, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বর্বরতার পথ খুঁজে নেয়; সুবিধেমত নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে। চাটুকারিতা এদের অন্যতম পুঁজি। এ শ্রেণির মানুষ বিশ্বাসঘাতক, কুলাঙ্গার, ভয়ংকর। এদের দ্বারা সব কিছুই সম্ভব। তৃতীয় শ্রেণির মানুষের উদ্দেশ্য প্রথম শ্রেণির মানুষের আস্থা অর্জন করে তাদের আক্রমণ করা, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য নৃশংসতার পথে হাঁটা। সুযোগ পেলেই তারা রক্তের হলি খেলায় মেতে ওঠে। বিশ্বের অনেক দেশের ন্যায় বাংলাদেশও এ পথে হেঁটেছে।

নৃশংস, জঘন্যতম ইতিহাস এ দেশের বুকে ভর করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে। ১৫ আগস্ট তারিখটি রহস্যময় কালোদিন। স্কটল্যান্ডের রাজা ম্যাকবেথের মৃত্যু থেকে জার্মান প্রেসিডেন্ট হিনডেনবার্গের নাৎসি বাহিনীকে আশীর্বাদ জানানো, অবশেষে বাঙ্গালি জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকান্ড এই ১৫ আগস্ট। একই তারিখ কি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান কিংবা তাঁদের পরিবার তথা মনুষ্যত্ব, মানবতা নিধনের ইঙ্গিত দেয় কি- না? ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তারই ধারাবাহিকতার অংশ কি-না বিশেষজ্ঞরা হয়তো খোঁজার চেষ্টা করবেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন। বিশ্বব্যাপী আগস্টের ভয়াবহতা, নৃশংসতার কালো অধ্যায় যেন আগস্ট আবছায়ার অকপট তেপান্তর।

আকাশও কিছু শোক সহ্য করতে পারে না বলে তারও মন খারাপ হয়, মেঘে সূর্য ঢেকে যায়, ভাপসা গরমে অসহনীয়, অতিষ্ঠ। ফুলগুলো নিস্তব্ধ হয়ে ভাবে এমন সৌরভ আজকের জন্য নয়। পশু -পাখিদের উদ্বিগ্ন শব্দ পরিবেশকে বিষন্ন করে তোলে। এমনই একটি কলংকিত তিমির রাত ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে, তবে তা হাহাকারের, নৃশংতার রাত। নির্লজ্জ, অকৃতজ্ঞ জাতির আজীবন প্রায়শ্চিত্তের রাত। দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের এজেন্ট, উচ্চাভিলাষী, বিপথগামী কাপুরুষোচিত কিছু লোক বাঙ্গালি জাতিকে ইতিহাসের পাতায় বানিয়েছে অকৃতজ্ঞ।

বাঙালি জাতির মনের কোনে বীজ বুনেছেন, দেখিয়েছেন মুক্তির, স্বাধীকারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে জীবন ও যৌবনের বর্ণিল সময়ের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন মহান স্বাধীনতার সর্বাধিনায়ক, রাজনীতির মহাকবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বৃটিশ আমলে ছাত্র অবস্থায় বন্ধু মালেককে অহেতুক মারধরের প্রতিবাদে সাতদিন কারাভোগের মাধ্যমে তারা বন্দী জীবন তথা অন্যায়, অবিচার,বৈষম্যের বিরূদ্ধে রাজনৈতিক বিকাশ, পথচলা শুরু হয়। বাকী ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারা ভাগ করতে হয় পাকিস্তান সরকারের চক্ষুশূল হওয়ার কারণে। সহ্য করেছেন জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন-ষড়যন্ত্র; তবুও পিছপা হননি; শোষিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার, মুক্তি আদায়ে।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ছিলো নীতি- আদর্শে খাঁটি মানুষের ভিড়। সে জন্যই সফল হয়েছেন, মহান স্বাধীনতার বীরত্ব গেঁথেছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধের পর হয়ে গেল তার উল্টো চিত্র। মেধাবী কিন্তু বেইমানের দল সারাক্ষণ থিক থিক করতো চারপাশে। চাটুকারিতায় নাজেহাল ছিলো বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শের সাদামাটা জীবনের সহজ-সরল হৃদয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় চাটুকার, তোষামোদি, বেইমানদের ঈঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন কিন্তু তাদের ভীড় থেকে বের হয়ে আসা কিংবা সেই ভীড়কে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া কতটুকু সম্ভব হয়েছে? নীতি আদর্শের মানুষগুলোকে শয়তান শ্রেনীর লোকগুলো কাছে আসার সুযোগ দিতো না। অভিমানে হয়তো দূরে সরে গিয়েছে কিন্তু নীতি -আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। তাইতো এখনো দুর্দিন-সংকটে নীতি আদর্শই কথা বলে।

আগস্ট মাস আসলেই বাংলার বাতাস ভারী হয়ে যায়। নিস্তব্ধ -নিথর শোকাতুর চারিপাশ। বন্ধু-শত্রু মিলেমিশে একাকার। শোকে বিহ্বল এ বসুন্ধরা ; অশুভের আবছায়া।শোকের এ শক্তিতে কত-যে অপশক্তির বাস তার খবরই-বা রাখি ক’জনা? শক্রু-বন্ধু মিলে বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়া দুঃসাধ্য বটে।

‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠন বনাম দেশি-বিদেশি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ও বিপথগামী উচ্চাভিলাষীদের ক্ষমতা দখলের খেলা। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সকল সদস্যসহ( শেখ হাসিনা,শেখ রেহানা দেশের বাহিরে অবস্থান করায় তাঁরা ব্যতিত) ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারে ৯ জন, আব্দুব রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির পরিবারের ১৩ জন,বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিল উদ্দিন আহমেদ এবং সাভারে ১১ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৩৪ জন শাহাদত বরণ করেন।

‘৭৫ এর ১৬ আগস্ট সৌদি আরবের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, ৩১ আগস্ট চীনের স্বীকৃতি, পাকিস্তান সরকার মোস্তাক সরকারকে অভিনন্দন, পশ্চিমা পরাশক্তির ভূমিকা কিংবা হত্যাকারীদের প্রতিষ্ঠিত করা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ইতিহাসও অনেক কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যায়। এখন হয়তো ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পরিবর্তন হয়েছে। এমন বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের পর বাধাগ্রস্ত হয় বঙ্গবন্ধুর মেন্ডেট সোনার বাংলা গঠন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুর্নগঠনের কাজ। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে রক্তের হলি খেলা সেই থেকে শুরু। দীর্ঘ ২১ বছর চলে এমন বিভৎস প্রতিযোগিতা। শেখ রাসেলের মতো ছোট্ট শিশুও কি বুঝতো অপরাজনীতির এসব কুটচাল? তবে কেন তাকেও নির্মমতার বলি হতে হলো? হয়তো এখনো পিপীলিকার মতো হাঁটে অলিকে হলিতে।

আউল-বাউল, চাষা-ভুষা, শ্রমিক-মজুর, আবাল- বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে সকল শ্রেণির শোষিত- নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের একমাত্র ভরসারস্থল ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু ঘোষণার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরীণ করা রাষ্ট্র ভাষা বাংলা দাবিকে আরও শক্তিশালী করে। বাউল সাধক কামাল পাশার বাউলা সুরে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

“ঢাকার বুকে গুলি কেন ?
নুরুল আমিন জবাব চাই
ওসে উর্দ্দু প্রেমে মন মজাইয়া,
মারলো কতো শহীদ ভাই।
ওসে উর্দ্দু প্রেমে মন মজাইলো,করলো কত রং বড়াই।।

শেখ মুজিব কারাগারে,
আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে
সত্যাগ্রহে এক কাতারে,
সামনে আছেন সামাদ ভাই।।”

এরপর ‘৫৪ এর নির্বাচন, ‘৬৬ এর ৬ দফা, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন সর্বশেষ ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মুক্তির সনদ স্বাধীনতা রচিত হয়। আন্দোলন চলাকালীন বাউল সাধক শাহ আব্দুল করিমের আহ্বান—
‘পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌ-দিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ রে জাগ রে মজুর-কৃষাণ॥’

জীবিত আত্মা, প্রাণ, আদর্শ- নীতির চেয়ে মৃত আত্মা, প্রাণ, আদর্শ-নীতি অসীম শক্তির অধিকারী। প্রেরণা-অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকে আজীবন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নত মম শির হয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন। কবি কামাল চৌধুরী বাঙালির জাতির অব্যক্ত আবেগ এভাবে প্রকাশ করেন—
“তুমি বাংলার ধ্রুবতারা
তুমি হৃদয়ের বাতিঘর
আকাশে বাতাসে বজ্রকণ্ঠ
তোমার কণ্ঠস্বর।।

তোমার স্বপ্নে পথ চলি আজো
চেতনায় মহীয়ান
মুজিব তোমার অমিত সাহসে
জেগে আছে কোটি প্রাণ||”

কিংবা হাসান মতিউর রহমানের ভাবনা—
‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত,
বঙ্গবন্ধু মরে নাই।
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো,
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।
তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা,
আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’
তবে বাঙ্গালি আজীবন শোকের সাগরে না ভেসে পূর্ণ থাকতো।

পিআইডি ফিচার।
লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, রামগড়,খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!