কষ্ট ভুলতে ড্যান্ডিতে আসক্ত হচ্ছে পথশিশুরা

বড় হয়ে শিক্ষিকা হতে চাওয়া কুলছুমা এখন ড্যান্ডির নেশায় সঁপে দিয়েছে নিজেকে। কুলছুমার মা মনোয়ারা বেগম ভিক্ষা করতে চলে যাওয়ার পর মেয়ে তার বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষা করতে। দিনের পর দিন অন্য বন্ধুদের নেশা করতে দেখে তারও আগ্রহ জাগে এর স্বাদ নিতে। সেই আগ্রহই একসময় পরিণত হলো নিত্যকার অভ্যাসে।

নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় একটু নজর দিলেই দেখা যায়, কিছু অপ্রাপ্তবয়স্ক পথশিশুকে হাতে পলিথিন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। দূর থেকে দেখে মনে হয়, তারা বেলুনের পরিবর্তে পলিথিন ফুলিয়ে খেলা করছে। কিন্তু কাছে যেতেই দেখা মেলে পলিথিনের ভেতরে হলুদ রঙের জুতার গাম। জুতা কিংবা ফোমে ব্যবহৃত আঠা পলিথিনে ভরে কিছুক্ষণ পরপর মুখের সামনে নিয়ে শ্বাস টেনে নেশা করতে দেখা যায় এই শিশুদের।

কি এই ড্যান্ডি: সাধারণত জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত এক ধরনের গাম বা আঠা যার গন্ধ শুঁকে বা পলিথিনের প্যাকেটে গরম জলের মধ্যে সেই গাম মিশিয়ে তার ধোঁয়া নাক, মুখ দিয়ে নেওয়া হয়। যার ফলে দেহের এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি দুর্বল হয়ে যায় এবং গা-হাত-পা ঝিমঝিম করে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাত-আট বছর থেকে শুরু করে চৌদ্দ -পনেরো বছর বয়সের প্রায় ১৫ থেকে ১৬ শিশু- কিশোর হাতে পলিথিন নিয়ে তার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আবার ধূমপান করছে। ছেলেরাতো রয়েছে, আছে মেয়ে শিশু-কিশোরীরাও। মাঝেমধ্যে রাস্তার লোকজনকে দেখে লুকিয়ে নিলেও পরে আবারো হারিয়ে যাচ্ছে নেশার রাজ্যে।

তেমনি কিছু শিশু-কিশোরের সাথে কথা বলে জানা যায়, পলিথিনের ভিতরে রাখা আছে হলুদ রঙয়ের জুতার গাম। বাচ্চারা পলিথিনের ভিতর নাক-মুখ ঢুকিয়ে গামের ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় মগ্ন হয়ে যায়। একটি ৩০ টাকার ঘাম দিয়ে তারা দুই থেকে তিন ঘণ্টা ঘ্রাণ নিতে পারে। এটা তাদের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়, জানায় তারা।

১০ বছর বয়সী কুলছুমা দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলে, আমি অক্সিজেন ইলিয়াস সভাপতি কলোনিতে থাকি। আগে আনন্দ স্কুলে পড়তাম। বড় হয়ে শিক্ষিকা হওয়ার অনেক ইচ্ছে ছিল। বন্ধুরা বলে গরিবদের পড়ে কি হবে! আমার মাও ভিক্ষা করতে চলে যায়। আর আমি আমার বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যায় ঘুরি ফিরি।

কুলছুমা জানায়, আমার সাথে থাকা রিমা, তারেক, মনি, সাথী, রিয়াজ আরো অনেকে গাম খায়। একদিন রিমা আমাকে গাম দিয়ে বলে, ‘খেয়ে দ্যাখ, আর কোনোদিনও ক্ষুধা, দুঃখ ও কষ্টের কথা মনে থাকবে না।’ একদিন খাওয়ার পর আমার ভালো লেগে যায়। সেই থেকে আমারও এই গাম খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন না খেলে খারাপ লাগে।

এই নেশার টাকা কিভাবে জোগাড় হয় জানতে চাইলে কুলছুমা বলে, একটা গামের দাম ৩০ টাকা। অনেক সময় মায়ের কাছ থেকে টাকা নিই। আবার অনেক সময় নিজে ভিক্ষে করে যে টাকা পাই, তা দিয়েই গাম কিনি।
১২ বছরের তারেক রহমান জানায়, ‘বড় হইয়া আমার পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা আছিলো। কিন্তু আমাগো মতো গরিব মানুষগো ইচ্ছা কি আর পূরণ অইবো। মা মইরা গেছে, বাবা আরেকটা বিয়া করছে। ঘরে এতোগুলা ভাই-বইন, ভালোমন্দ কিছু খাইবার পারি না। তাই বন্ধুগো লগে ভিক্ষা করি। তাগো লগে থাকতে থাকতে তাগো দেখায় এখন আমিও গাম খাই। ভালো লাগে গাম খাইতে। এইডা খাইলে পেডে আর ক্ষুধা লাগে না ‘
দেখা যায়, নেশাগ্রস্ত প্রতিটা শিশুই ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠস্বরে কথা বলে। নেশা করতে করতে তাদের কণ্ঠস্বরও পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখতে খুব রোগা। তারা এই নেশার কারণে তাদের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে অবগত না। তারা যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেক্ট্রনিক রিপেয়ারের দোকান বা জুতা মেরামতকারীদের (মুচি) কাছ থেকে ২০-৩০ টাকার বিনিময়ে এ গাম সংগ্রহ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার জানায়, এই গাম বা আঠা জুতা ও ফোম তৈরির কাজে লাগে বলে এর বিক্রি আইনি ভাবে নিষিদ্ধ না। যার কারণে এই গাম বিক্রি হয়ে থাকে।

পথশিশুদের কাছে কেন বিক্রি করা হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যখন দোকানে থাকি তখন কিন্তু বাচ্চাদের কাছে এই গাম বিক্রি করি না। কিন্ত দোকানে আরো কর্মচারী আছে, যারা আমার অবর্তমানে এটা বিক্রি করে থাকে।

রিকশাচালক কাদের আলী বলেন, এই বাচ্চাদের গ্যাং রয়েছে। তারা যে শুধু নেশা করছে তা নয়। তারা নানা খারাপ কাজে সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন মৌবাইল চুরি, ছিনতাই।

ড্যান্ডি নেশা শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জসিম উদ্দিন দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, এই জাতীয় নেশার কারণে শিশু-কিশোরদের ব্রেইন, লিভার এবং কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। পরে হার্টের অসুখও হতে পারে । এছাড়া তাদের শ্বাসনালীরও সমস্যা হতে পারে। এই নেশার ফলে ধীরে ধীরে দেহের সতেজ কোষগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং পরিশেষে আসক্ত ব্যক্তির মৃত্যুও হতে পারে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব তাদের এই নেশা থেকে সরিয়ে আনা দরকার।

এ নিয়ে পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়ার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগেও কয়েকজন বাচ্চাকে আমরা আদালতে চালান করি। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়াতে আদালতে তারা জামিন পেয়ে যায়। জামিন পেয়ে তারা আবারো পূর্বের মতো নেশা শুরু করে। এটা রোধ করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!