করোনার ভয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা এক জাহাজে অদ্ভূত সব কাণ্ড

জাহাজে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকে

৫৫ হাজার ২৩১ টন সয়াবিন নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পৌঁছার পর অভিনব সব ঘটনার জন্ম দিয়েছে ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’ নামে পণ্যবাহী একটি জাহাজ। নিয়ম অনুসারে ওই জাহাজ থেকে মালামাল নামানোর কথা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ওই জাহাজের মাস্টার ও নাবিকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অভিনব ‘আশঙ্কা’ জানিয়ে ওই জাহাজে কাউকে উঠতে দিচ্ছে না।

এটুকুতেই থেমে নেই মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পতাকাবাহী ওই জাহাজের নাবিকরা। জাহাজটি আসার মাত্র দুই দিনের মাথায় তারা চট্টগ্রাম বন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছে ভারত সরকারের কাছে। ভারতীয় ইউনিয়নের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে জাহাজ মালিকের বিরুদ্ধে। এরপর লন্ডনভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে দীর্ঘ অভিযোগ।

রোববার (২৯ মার্চ) ২২ জন নাবিকসহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’ নামে ওই জাহাজটি চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায়। পৌঁছানোর পর থেকে তাদের অভিযোগ একটিই— করোনাভাইরাস শনাক্ত করা কিংবা নাবিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনাভাইরাস শনাক্তের সব ব্যবস্থা ও সুরক্ষাই রয়েছে বন্দরে। বৃহস্পতিবারও (২ এপ্রিল) ৪৫টি জাহাজ থেকে পণ্য নামানো হয়েছে সুন্দরভাবে। কারও কোনও অভিযোগ ছিল না। এমন অবস্থায় অনেকেরই সন্দেহ, ওই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বিরুদ্ধে একটি ‘ইস্যু’ তৈরির চেষ্টা করছে।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসেই চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো সমস্যা ছাড়াই খালাস হয়েছে গড়ে ৩৫০টি জাহাজের মালামাল। কেউ কোনো অভিযোগ তোলেনি।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো জাহাজ আসার পর স্থানীয় শিপিং এজেন্ট— চট্টগ্রাম বন্দর এবং জাহাজ হ্যান্ডলিং অপারেটরদের সঙ্গে সমন্বয় করে একজন অপারেটর নিয়োগ করে জাহাজ থেকে মালামাল খালাসের জন্য। এরপর ওই অপারেটর পণ্য খালাস করতে জাহাজে শ্রমিক পাঠায়।

এভাবে করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর মধ্যেও জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ চলে আসছে চট্টগ্রাম বন্দরে।

এমন অবস্থায় আবার ‘অদ্ভূত’ দাবি তুলেছেন ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’র মাস্টার রজনীশ শাহ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করে মালামাল খালাসের দাবি জানিয়েছেন। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে ভাসমান ক্রেনের ব্যবহার নেই, ছিলও না কখনও।

এর মধ্যেই ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’র মাস্টার ও নাবিকরা ‘অভিযোগ’ জানিয়েছেন ভারত সরকারের কাছে। সেখানে তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল খালাসে ‘আতঙ্কজনক’ অবস্থার কারণে তারা একরকম ‘জিম্মি’ হয়ে রয়েছেন।

এদিকে মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করা ওই জাহাজ থেকে বন্দরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে লন্ডনভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছেও। ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, যদি মালামাল খালাসে জাহাজে লোক উঠতে দেওয়া না হয়, তাহলে জাহাজের মালিক তাদের বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছেন।

বুধবার (১ এপ্রিল) ‘হিউম্যান রাইটস এট সি’ নামের ওই মানবাধিকার সংস্থার এক বিবৃতি থেকে জানা গেছে, ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’র নাবিকরা ইতিমধ্যে ভারত সরকার ছাড়াও ভারতীয় ইউনিয়ন এবং পতাকাবাহী রাজ্য প্রশাসনের কাছেও লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কথিত ‘আতঙ্কজনক’ অবস্থা নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। মালামাল খালাসের জন্য ৬০ জন শ্রমিক সেখানে খালাস না হওয়া পর্যন্ত থাকবে। এটা তাদের জন্য আতঙ্কজনক বলে ওই নাবিকদের দাবি।

এদিকে স্থানীয় শিপিং এজেন্ট বলছে, ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’ জাহাজের মাস্টার রজনীশ শাহের সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অবাস্তব।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বৃহস্পতিবারও (২ এপ্রিল) ৪৫টি জাহাজ থেকে পণ্য নামানো হয়েছে সুন্দরভাবে। কারও কোনও অভিযোগ ছিল না। কিন্তু মাস্টার (এমভি টমিনি ডেস্টিনি জাহাজের মাস্টার রজনীশ শাহ) তার জাহাজে কোনো নাবিককে মালামাল খালাসের জন্য উঠতে দিচ্ছেন না।

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী বন্দরে ঢোকার সময় আমরা সবাইকে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করি।’

ওমর ফারুক আরও বলেন, ‘শিপিং অপারেটররা মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করছে। সকলের জন্য স্ক্যানের ব্যবস্থা রেখেছে। বন্দর ও জাহাজের কর্মীদের জন্য রয়েছে মেডিক্যাল টিম। এছাড়া বন্দরের প্রবেশপথে রয়েছে হাত ধোয়ার সুবিধাও।

যোগাযোগ করা হলে ‘এমভি টমিনি ডেস্টিনি’ জাহাজের স্থানীয় শিপিং এজেন্ট সেফ শিপিং লাইনস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মৃদুল কান্তি দাশ বলেন, ‘ওই জাহাজের নাবিকদের দাবি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও ভিত্তিহীন।’

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে এমভি টমিনি ডেস্টিনির মাস্টার (রজনীশ শাহ) পণ্য খালাসের অনুমতি দিতে চান না। যদি জাহাজেই ওঠা না যায়, তাহলে পণ্য কিভাবে নামানো সম্ভব? চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব জাহাজ নিয়মিত মালামাল খালাস করে যাচ্ছে, ওই জাহাজের নাবিকরা তাদেরও অনুসরণ করতে চান না।’

মৃদুল কান্তি দাশ বলেন, ‘বাইরে থেকে আসা সব জাহাজ থেকে সুন্দরভাবে মালামাল ওঠা-নামার কাজ চলছে, কিন্তু তিনি (এমভি টমিনি ডেস্টিনি জাহাজের মাস্টার রজনীশ শাহ) বলছেন, তার জাহাজে কাউকে উঠতে দেবেন না। তিনি চান ভাসমান ক্রেন দিয়ে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করতে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও ভাসমান ক্রেনের সুবিধা নেই।’

‘জাহাজটিতে ৭০ কোটি টাকার মালামাল রয়েছে। মালামাল নামাতে না দেওয়ায় প্রতিদিনই আমদানিকারককে লোকসান গুণতে হচ্ছে। তাই আমরা জাহাজের মাস্টারকে তার নাবিকদের নিয়ে অন্তত ১০ দিন জাহাজের বাইরে নিরাপদ কোনো জায়গায় থাকতে বলেছিলাম। এই ১০ দিনে আমরা মালামাল নামিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু তারা এটাও না মেনে উল্টো বিভিন্ন জায়গায় অবাস্তব অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছেন’— বলেন তিনি।

বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বন্দরে যারাই প্রবেশ করে, তাদের সবাইকে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করা হচ্ছে। আসলে ওই জাহাজটি (এমভি টমিনি ডেস্টিনি) একটি ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!