এলইডি হেডলাইটের ঝাঁজালো আলো প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে সড়কে, শীতেই মৃত্যুঝুঁকি বেশি

চট্টগ্রামে প্রতি দুটি দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে একজন

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটছে প্রাণহানি। দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগেই। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামে গড়ে প্রতি দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় একজন করে মারা যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ ও চালকরা বলছেন, মোটরযানের হেডলাইটের তীব্র আলোকরশ্মি বা হাই-বিম রাতের দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ। এছাড়া অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করাও এসব দুর্ঘটনার কারণ।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের তথ্যমতে, দুর্ঘটনার সংখ্যা ঢাকায় বেশি হলেও প্রাণহানিতে এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম। এই বিভাগে গত বছর ৯৫২টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৬৩ জন। আনুপাতিক হিসাবে গড়ে প্রতি দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় একজন করে মারা যায় চট্টগ্রামে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৩৮ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৭ দশমিক ৫১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২১ দশমিক ৩ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।

শীতেই ঝুঁকি বেশি

শীত মৌসুমে চালকরা গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে জানান, ঘন কুয়াশার মাঝে ড্রাইভিং করার ক্ষেত্রে সামনের রাস্তার দৃষ্টিসীমা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম হয়ে যায়। তখন গাড়িতে যদি ফগ লাইট থাকে কিংবা ড্রাইভিং লাইট থাকে, তবে তা ব্যবহার করতে হয়। মূলত এই লাইটগুলো গাড়ির সামনের রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত আলোকিত করে দেখতে সাহায্য করে। গাড়িতে ফগ লাইট বা রিভিং লাইট না থাকলে বিম লাইট ব্যবহার করতে হয়।

তবে অভিজ্ঞচালকদের অভিমত, বিম কম রশ্মি ব্যবহার করা উচিত। কারণ ঘন কুয়াশা হাই বিম লাইট রিফ্লেক্ট করে দেয়। কুয়াশা কমলে হাই বিম লাইটের কার্যকারিতা বাড়তে থাকে। তাই এক্ষেত্রে দেখতে হবে কুয়াশা অনুযায়ী কোন্ লাইট ভালো কাজ করে।

চালকদের এও অভিমত, কুয়াশা কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফগ লাইট বন্ধ করে ফেলা উচিত। তা না হলে অন্য ড্রাইভারদের জন্য তা বিভ্রাান্তিকর হতে পারে। কিন্তু সারা দেশের মত চট্টগ্রামের গাড়ির চালকরা তা করেন না। এ কারণে অহরহই ঘটছে দুর্ঘটনা।

চোখধাঁধানো আলোয় খেই হারায় চালক

ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত করা ইউনিক গাড়ির চালক জয়নাল ইসলাম বলেন, ‘গাড়ি হয়তো কোনো একটা ফ্লাইওভার থেকে নিচের সড়কের নামবে, তখন উল্টো দিক থেকে আসা অন্য গাড়ির চোখধাঁধানো আলোয় খেই হারিয়ে ফেলেন। গাড়ি এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে প্রায় সময়ই দুর্ঘটনায় পড়ে।’

নয়ন নামে আরেক চালক তার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন বহদ্দারহাট। তার গাড়ি নিয়ে ফ্লাইওভার থেকে নামার পরেই বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরসাইকেলের ব্যাপক সাদা আলোর বিচ্ছুরণ তার দৃষ্টিশক্তি তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। ততক্ষণে ব্রেক কষেও রক্ষা হয়নি। একপর্যায়ে সড়ক বিভাজকের ওপর উঠে পড়ে অটোরিকশা।

এদিকে মোটরসাইকেল চালক জিয়াদ যাচ্ছিলেন এয়ারপোর্টে। রাতে তার এক আত্মীয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসার কথা ছিল। গাড়ি চালাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই তীব্র সাদা আলোর ঝলকানিতে পথ হারিয়ে ফেলেন তিনি। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পুরো তিন মাস তাকে কাটাতে হয়েছে হাসপাতালে।

যে সাদা আলোর কথা বলা হচ্ছে, তা আর কিছুই না— মোটরযানের হেডলাইটের আলো। প্রাইভেট কার, ট্রাক, বাস থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহনে এখন তীব্র সাদা আলোর হেডলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তীব্র সাদা আলো দেয়— এমন এলইডি হেডলাইট প্রাইভেট কার এবং পিকআপ ভ্যানেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। মোটরসাইকেলেও ব্যবহার করা হচ্ছে এলইডি হেডলাইট।

রাতের দুর্ঘটনায় সাদা আলোই মূল কারণ

চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি তীব্র সাদা আলো উৎপাদনকারী হেডলাইট। যা এখনই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

জানা যায়, গাড়ির হেডলাইট সাধারণত তিন ধরনের হয়। এগুলো হলো হ্যালোজেন, জেনন ও এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড)। তবে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে হ্যালোজেন হেডলাইট— এটিও সাদা আলো দেয়। তবে এলইডি লাইটের মতো সেটি অতোটা তীব্র নয়।

চালকরা বলেছেন, বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির সাদা আলোর কারণে তাদের দেখতে অসুবিধা হয়। এ কারণে নিয়মই রয়েছে, হেডলাইটের ওপরের অংশে দুই ইঞ্চির মতো জায়গায় কালো কালির প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়ার। কিন্তু এ নিয়ম কেউ মানে না। সাথে আবার শুরু হয়েছে এলইডি সাদা লাইটের ব্যবহার। অথচ এর ফলে মৃত্যুঝুঁকি কতটা বাড়ছে— তা নিয়ে প্রশাসনের কোনো প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যথা নেই।

সরকারি কর্মকর্তা সামসুল ইসলাম জানান, এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি মোটরসাইকেল চালান। আগের দিনগুলোতে মোটরসাইকেলসহ প্রতিটি গাড়ির হেডলাইটের ওপরের অংশে ছিল কালো রং করা— যাতে কারও চোখে আলোকরশ্মি না পড়ে এবং যারা গাড়ি চালায় তাদের গাড়ি চালাতে কষ্ট না হয়। এতে দুর্ঘটনাও কম হতো। বর্তমান যুগে এসে নানা ধরনের লাইটের আলো চোখে এমনভাবে এসে পড়ে যে সামনে কী আসছে— কিছুই বোঝা যায় না। এই ঝুঁকি এড়াতে রাতে বাইক বের করতেই তিনি ভয় পান।

৪৫ কিলোমিটার সড়কে ৫০টি বাঁক

এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শাহ্ আমানত কর্ণফুলী সেতু থেকে দোহাজারী শঙ্খ নদীর ব্রিজ পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে ৫০টি বাঁক যেন এক মরণফাঁদ। সেখানে সামনে থাকা কোন গাড়ির হেডলাইটের আলো অনিয়ন্ত্রিত হলে শীতের কুয়াশায় গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয় বলে জানান এস আলম পরিবহনের চালক নাসির উদ্দিন।

এই চালক বলেন, ‘আমার গাড়ির পিছনের হেডলাইট আমি তখনই জ্বালাবো, যখন আমি আমার গাড়ি ব্রেক করব। অন্য গাড়ির চালক সেই আলো দেখে আমাকে যাওয়ার জায়গা করে দেবে। কিন্তু অনেক অদক্ষ ড্রাইভার যদি তার গাড়িতে এলইডি হাই-বিম করে রাখে, তাহলে সেই চালক সামনের গাড়িকে দেখতে সমস্যায় পড়বে। তখন গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়বেই।’

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাতের বেলায় অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হাই-বিম ব্যবহার করা। লো-বিম ব্যবহার না করলে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়বেই।’

তার কথার সূত্র ধরে জানা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কিছু জায়গার বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে হেডলাইটের তীব্র আলো বা হাই-বিমে পটিয়ার মইজ্জারটেক পর্যন্ত মনসার টেক, বাদামতল, গৈড়লার টেক, আমজুর হাট টেক, পটিয়া পোস্ট অফিস মোড়, আদালত গেইট মোড়, থানার মোড়, ডাকবাংলার মোড়, কমল মুন্সির হাট মিলে ৩০টি পয়েন্টে এবং চন্দনাইশ উপজেলার ২০টি পয়েন্টে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রয়েছে। দেখা গেছে, পটিয়ার মনসা থেকে দোহাজারী শঙ্খ ব্রিজ পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়কেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। তাই এ সড়কে গাড়িতে তীব্র আলোর এলইডি লাইট ব্যবহার করা বিপজ্জনক বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাসচালকদের আরও কয়েকজন।

চলতি বছরের ২০ মার্চ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া এলাকায় ট্রাক ও হিউম্যান হলারের সংঘর্ষে ১৫ জন নিহত হন। রাত পৌনে দশটার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। কক্সবাজার থেকে লবণ বোঝাই ট্রাকের গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম। অন্যদিকে লোহাগাড়া থেকে ছেড়ে যাওয়া ছোট হিউম্যান হলারের গন্তব্য ছিল চকরিয়া। জাঙ্গালিয়া বনবিভাগের রিজার্ভ অফিসের সামনে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় গাড়ি দুটির। এতে ঘটনাস্থলেই হিউম্যান হলারের চালকসহ মারা যান ১১ জন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পথে মারা যান দুইজন। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরও দুইজন।

আইনে কী আছে?

২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের মোটরযান চলাচলের সাধারণ নির্দেশাবলীর দ্বিতীয় অংশে উল্লেখ রয়েছে— ‘রাত্রিবেলায় বিপরীত দিক থেকে আগত মোটরযান চালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এরূপ হাইবীম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাইবে না।’

দেশের প্রথম মোটরসাইকেল ব্লগ বাইক বিডিতে প্রকাশিত ‘মোটরসাইকেল হেডলাইট সিস্টেম আপগ্রেড কেন: কেন আপগ্রেড করবেন’ প্রবন্ধে উল্লেখ আছে, ‘রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে হেডলাইটের ভিজিবিলিটি মোটরসাইকেলের রাইডারকে সাপোর্ট করে। দ্বিতীয়ত অন্য গাড়ি আসার সময় যেন সাবধান হতে পারে এবং নিজেকে সেইফ করতে পারে। তো যখন আমরা মোটরসাইকেলের লাইটিং সিস্টেম আপডেট করবো, তখন এইসব বিষয় মাথায় রেখে আপডেট করতে হয়। আমরা অনেকেই দেখে থাকি মোটরসাইকেলে অতিরিক্ত পাওয়ারফুল লাইট আপগ্রেড করে থাকেন, এতে করে ম্যাক্সিমাম ভিজিবিলিটি নিশ্চিত করে। তবে এই হেভিলাইটের কারণে অপর গাড়ির চালকের চোখে সমস্যা হতে পারে— যা খুব রিস্কি।

ভিজিবিলিটিঘটিত এই সমস্যার কারণে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই খুব সাবধানে এবং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী লাইটিং সিস্টেম আপগ্রেড করতে হবে। আর আমরা তখনই লাইট ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করবো যখন এর প্রয়োজন হবে।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অন্য কারণগুলোর সঙ্গে মোটরযানের হাই-বিম বা হেডলাইটের তীব্র আলোর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মোটরযানের এ অনিয়মের জন্য জরিমানা করা হয়েছে। আসলে অদক্ষ চালক রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে হেডলাইটের আলোর ব্যবহার জানে না। তাই বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির হাই-বিমের কারণে চালকের দেখতে অসুবিধা হয় বলে, হেডলাইটের ওপরের অংশে দুই ইঞ্চির মতো জায়গায় কালো কালির প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু গাড়ির মালিক ও চালকরা এটি করতে আন্তরিক না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!