আফগানিস্তানের জয়রথ থামলো মাসাকাদজার জিম্বাবুয়ের কাছে

জন্মদিনে বিবর্ণ রশিদ, শেষটা রাঙালেন মাসাকাদজা

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তানের জয়ের গাড়ি উল্কা বেগে ছুটছিল। যেভাবে তারা ছুটছিলেন কোথায় গিয়ে থামে এটিই ছিল দেখার বিষয়। অবশেষে রেকর্ড ১২ জয়ের পর হ্যামিল্টন মাসাকাদজার বিদায়ী রঙিন ইনিংসে থামলো আফগানিস্তানের জয়রথ। একই সাথে টি-টোয়েন্টিতে আফগানদের বিরুদ্ধে প্রথম জয়ের দেখাও পেল জিম্বাবুয়ে। বড় বর্ণিলভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন মাসাকাদজা। আসলে এমন বিদায়ই তো চেয়েছিলেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। জীবনের শেষ ম্যাচে প্রায় একা হাতে দলকে জেতালেন। আফগানিস্তানকে হারাল জিম্বাবুয়ে ৭ উইকেটে। টি-টোয়েন্টিতে মুখোমুখি ৯ লড়াইয়ে এই প্রথমবারের মতো জিম্বাবুয়ে জিতল আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে। আর সেই জয়ে ২২ গজে নায়ক জিম্বাবুয়ের বিদায়ী অধিনায়ক মাসাদকাজদা।

জীবনের শেষ আর্ন্তজাতিক ম্যাচ নিয়ে নাতি-নাতনিদের কাছে অনেক গল্প করতে পারবেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই পারফর্মার। আর অধিনায়ক হিসেবে এই প্রথম কোন ম্যাচে হার দেখলেন আফগানিস্তানের রশিদ খান। তাও আবার কোনদিন? যেদিন তার জন্মদিন! ৪২ বলে ৭১ রান করে মাসাকাদজা যখন আউট হলেন তখন ম্যাচ জয়ের প্রায় দারপ্রান্তে দাড়িয়ে জিম্বাবুয়ে। সেসময় তাদের চাই বাকি ৪৩ বলে ৪৬ রান। হাতে জমা ৮ উইকেট।বাকি দায়িত্ব পালন করেন রেগিস চাকাভা (৩২ বলে ৩৯ রান) ও শন উইলিয়ামস (২৪ বলে অপরাজিত ২১ রান)।

৭১ রান করে জয় থেকে খানিকদূরে আউট হয়ে যান ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলা মাসাকাদজা। তাকে বিদায়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক রশিদ খান।
৭১ রান করে জয় থেকে খানিকদূরে আউট হয়ে যান ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলা মাসাকাদজা। তাকে বিদায়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক রশিদ খান। ছবি: আজীম অনন

দৌলত জাদরানের বলে ১২.৫ ওভারে মোহাম্মদ নবীর হাতে ক্যাচ হয়ে ৭১ রান করে মাসাকাদজা যখন ফিরছেন তখন মাঠের সব কর্নার থেকে আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা ছুটে এসে হাত মেলালেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়কের সঙ্গে। এমনভাবে মাঠে আর মাসাকাদজার সঙ্গে দেখা হবে না কারোর। তাই সবাই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় রাখতে তার সঙ্গে হাত মেলালেন। বললেন-ধন্যবাদ বিগম্যান! আর জীবনের শেষ ইনিংসে সত্যিকার অর্থেই জিম্বাবুয়ের বিগম্যান ‘বিগ’ কাজই করেছেন। এই ম্যাচে জয় জিম্বাবুয়েকে ফাইনালে তুলে আনতে পারেনি। কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে অনেক পুরানো একটা হিসেব ঠিকই চুকিয়েছে জিম্বাবুয়ে। টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তান এতদিন অজেয় ছিল জিম্বাবুয়ের সামনে। সেই হিসেব বদলে গেল এই ম্যাচ শেষে।

মাসাকাদজা এখন এই ম্যাচের প্রসঙ্গ এলেই বলতে পারবেন-‘ যে ম্যাচটায় আমরা প্রথম জিম্বাবুয়েকে হারিয়েছিলাম ওটাই ছিল আমার শেষ আর্ন্তজাতিক ম্যাচ’!

টসে জিতে আফগানিস্তান চট্টগ্রামের তিনজাতি টি – টোয়েন্টি সিরিজের এই ম্যাচে ৮ উইকেটে ১৫৫ রান তুলে। জিম্বাবুয়ে এই রান তাড়ায় নেমে মুজিব-রশিদ-নবীর স্পিন কেমন করে সামাল দেবে-তা নিয়েই আলোচনা ছিল। তবে যে কায়দায় পুরো ম্যাচে আফগানিস্তানের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে লড়লো জিম্বাবুয়ে, তাতেই ম্যাচ জয়ের সব শঙ্কা দুর তাদের।

আর এই জয়যাত্রায় একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজা নিজেই। মাত্র ২৭ বলে ৪ ছক্কা ও ২ বাউন্ডারিতে নিজের হাফসেঞ্চুরি পুরো করেন তিনি। দলের শুরুর ৭৯ রানের মধ্যে মাসাকাজদার রানই ৫১! তিন জাতি টি- টোয়েন্টির চার ম্যাচ থেকে এক জয় নিয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে জিম্বাবুয়ে। সিরিজের শুরুটা ভাল না হলেও শেষটাও তো সুন্দর হলো।

টসের পর বলেছিলেন ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটা জিতেই শেষ করতে চান তিনি। ম্যাচ শেষে কথা রাখলেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। শেষটা রাঙিয়ে গেলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে উড়ন্ত সূচনা করে আফগানিস্তান। দুই ওপেনার হজরতউল্লাহ জাজাই আর রহমানউল্লাহ গুরবাজ ৫৭ বলে গড়েন ৮৩ রানের জুটি। দশম ওভারের তৃতীয় বলে এসে এই জুটিটি ভাঙেন মুতুমবদজি, ২৪ বলে ৩১ রান করা জাজাইকে ফিরিয়ে।

তারপরও বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল আফগানিস্তান। ১২ ওভার শেষে তাদের বোর্ডে ছিল ১ উইকেটে ১০০ রান। সেখান থেকে টানা চার ওভারে ৪টি উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে দলটি। ফলে শেষ ৮ ওভারে ৭টি উইকেট হারিয়ে মাত্র ৫৫ রান যোগ করতে পেরেছে আফগানিস্তান। ১৩ বলে ১৬ রান করে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন শফিকুল্লাহ। ১৩তম ওভারের শেষ বলে ক্রিস্টোফার এমপুফুকে হাঁটু গেরে মারতে গিয়ে গায়ে লেগে যায় তার। রিভিউ অবশ্য নিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়নি।

পরের ওভারে দারুণ খেলতে থাকা গুরবাজও উইকেট দিয়ে বসেন। স্ট্যাম্প ছেড়ে শন উইলিয়ামসকে মারতে গিয়েছিলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। পেছন দিক দিয়ে বল ঢুকে মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে যায়। ৪৭ বলে ৪টি করে চার ছক্কায় গুরবাজ তখন ৬১ রানে। তার পরের দুই ওভারে আফগানরা হারায় মোহাম্মদ নবী (৪) আর নাজিবুল্লাহ জাদরানকে (৫)। এরপর আর কেউ সেভাবে ব্যাট হাতে ভয় ছড়াতে পারেননি। গুলবাদিন নাইব ৭ বলে ১০ আর রশিদ খান ৬ বলে ৯ রানে অপরাজিত থাকেন।

জিম্বাবুয়ের পক্ষে বল হাতে সবচেয়ে সফল ছিলেন ক্রিস্টোফার এমপুফু। ৪ ওভারে ৩০ রান খরচায় ৪টি উইকেট নেন এই পেসার।

আফগানিস্তানকে ঝড়ো সূচনা এনে দিয়েছিলেন জাজাই। ছবি: আজীম অনন
জিম্বাবুয়েকে ঝড়ো সূচনা এনে দিয়েছিলেন হজরুতুল্লাহ জাজাই। ছবি: আজীম অনন

বিদায় ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখতে এদিন ভিন্ন জার্সি নাম্বার নিয়ে মাঠে নামেন মাসাকাদজা। সেই সঙ্গে নামের জায়গাতেও লেখা ছিল না তার নাম। জার্সির পেছনে ডাক নাম নিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দেন তিনি। জার্সির নম্বর ৩১০ এবং ডাকনাম মুধারা লিখে খেলতে নামেন মাসাকাদজা। জিম্বাবুয়ে দলের মিডিয়া ম্যানেজার ডার্লিংটন এই বিষয়ে জানান, ‘এটি তিন ফরম্যাটে খেলা মাসাকাদজার ম্যাচ সংখ্যা, মুধারা তার ডাক নাম।’

২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের হয়ে অভিষেক হয়েছিল মাসাকাদজার। এছাড়া দেশটির প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি।

দেশটির সর্বোকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকানোর কীর্তি রয়েছে এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। দেশের হয়ে মোট ৩৮টি টেস্ট খেলেছেন জিম্বাবুয়ের এই অধিনায়ক। সেই সঙ্গে ২০৯টি ওয়ানডে ম্যাচে ২৬৫৮ রান করেছেন দেশের হয়ে। আইসিসির নিষেধাজ্ঞার পর জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে অবসরের ঘোষণা দিলেন মাসাকাদজা।

মাসাকাদজার রঙিন দিনে অনেকটাই বিবর্ণ রশিদ খান। পুরো সিরিজে বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের নাচানো আফগান অধিনায়ক এদিন উইকেটশূন্য থাকেন তিনি। চার ওভার বল করে ২৯ রান দেন রশিদ। জন্মদিনটা তাই একটু ফিকেই হয়ে গেল রশিদের। আগের বছর ২০তম জন্মদিনে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন রশিদ খান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টসের পর সে কথা উল্লেখ করে এদিনও তেমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা হল না।

ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। এই ম্যাচ ছিল তাই শুধুই নিয়মরক্ষার। শনিবার আরেকটি নিয়মরক্ষার ম্যাচে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। পরে ২৪ সেপ্টেম্বর ফাইনালে মুখোমুখি হবে দুদল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: আফগানিস্তান ১৫৫/৮ (২০ ওভারে, গুরবাজ ৬১, জাজাই ৩১, শফিকুল্লাহ ১৬, গুলবাদিন নায়েব ১০. ফজল ১২, এমপফু ৪/৩০, মতুমবদজি ২/১৮)।

জিম্বাবুয়ে: ১৫৬/৩ (১৯.৩ ওভারে, টেলর ১৯, মাসাকাদজা ৭১, চাকাভা ৩৯, উইলিয়ামস ২১*, মুজিব উর রহমান ২/২৮)।
ফল: জিম্বাবুয়ে ৭ উইকেটে জয়ী। ম্যাচ সেরা: ক্রিস এমপফু।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!