আওয়ামী লীগ নেতার প্রত্যয়নে ৫ মামলায় জামিন নিয়ে হেফাজত নেতার মুক্তি

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে থানায় হামলাসহ হেফাজতের সহিংস তাণ্ডবের ঘটনায় গ্রেপ্তার হেফাজত নেতা উজায়ের আহমেদ হামিদী ৫ মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

ওই হেফাজত নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন দলটির উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। সেই প্রত্যয়নপত্র জামিন আবেদনের সঙ্গে আদালতে দাখিল ও ‘রাষ্ট্রপক্ষের জোরালো বিরোধিতা না থাকায়’ সহজেই জামিন পেয়ে যান তিনি। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন বলে দাবি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমানের।

তবে সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তির এমন কর্মকাণ্ডে হতবাক জেলা ও নগরের অনেক নেতাকর্মী। তাদের মতে, দলের নেতা হিসেবে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির পক্ষ নিয়ে তিনি খারাপ নজির সৃষ্টি করলেন।

গ্রেপ্তারের এক মাসের মধ্যে থানায় আক্রমণসহ সহিংসতার মামলার আসামি হেফাজত নেতার জামিন ও মুক্তি নিয়ে বিস্মিত হন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও। পুলিশ জেলগেট থেকে আবারও ওই হেফাজত নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে, পরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওই হেফাজত নেতার পাঁচ মামলায় জামিন বাতিলের আবেদন করলে আদালত ভার্চুয়াল শুনানি সম্পন্ন করে তার জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

শুক্রবার (১৪ মে) ঈদের দিনেও চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল আদালতে উপস্থিত হয়ে পরোয়ানায় সই করেন। বেঞ্চ সহকারীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয় হাটহাজারী থানায়।

জানা গেছে, উজায়ের আহমেদ হামিদী হেফাজতে ইসলামের হাটহাজারী উপজেলা শাখার দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক। তিনি হেফাজতের যেকোন কর্মসূচিতে অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন। সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে তিনি সব সময় সরব। এছাড়া হাটহাজারীতে তিনি কট্টর সরকার বিরোধী হিসেবেও পরিচিত। হাটহাজারী থানায় ভাংচুর ও ভূমি অফিসে আগুন দেওয়াসহ সকল তান্ডবে সে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিল বলেও জানা গেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন নোমানের প্রত্যয়নপত্রে বনে যান আওয়ামী লীগের একজন সক্রীয় কর্মী। সহিংসতার ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর মুক্তি পেয়ে যান। একজন সরকার দলীয় দলের নেতা হয়ে কিভাবে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড সমর্থনে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে হেফাজত নেতাকে জেল থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে তা নিয়ে সবার মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা।

৬ মে উজায়ের চার মামলায় জামিনের আবেদন করেন। তার জামিন আবেদনের সঙ্গেই ছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রত্যয়নপত্র। রাষ্ট্রপক্ষের জোরালো বিরোধিতা না থাকায় চার মামলায় তিনি জামিন পান। ৯ মে চার মামলার জামিননামা কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ঈদের বন্ধ শুরুর আগের দিন বুধবার (১২ মে) সকালে আরেকটি মামলায় তিনি জামিন পান। দুপুরের মধ্যে ওই জামিননামাও কারাগারে পাঠানো হয়। পাঁচ মামলার প্রতিটিতে উজায়েরের পক্ষে জামিন আবেদনের সঙ্গে হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্যাডে সাধারণ সম্পাদক মো. সোহরাব হোসেন চৌধুরী নোমানের সই করা প্রত্যয়নপত্র জমা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন বলেও জানা গেছে। ১ এপ্রিল তারিখে সই করা ওই প্রত্যয়নপত্রে লেখা আছে— ‘উজায়ের আহমেদ হামিদী ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সবসময় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে হাটহাজারী পৌরসভা আওয়ামী লীগের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা। আমরা তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি’।

উজায়েরের জামিনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর জেলা পুলিশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা পিপি আ ক ম সিরাজুল ইসলাম খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, উজায়েরের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি মিথ্যা। ওই দিনই (বুধবার) দুপুর ২টার দিকে তিনি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে উজায়েরের পাঁচ মামলার জামিন বাতিলের আবেদন করেন। বিকেল ৩টায় জেলা ও দায়রা জজ ভার্চুয়ালি আদালতে জামিন বাতিল করে পাঁচ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মুক্তির পর তাকে হেফাজতে নেয় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।

সোহরাব হোসেন নোমান বলেন, ওজায়ের ২০০৪ সাল থেকে ছাত্রলীগ করে আসছে। বছর তিনেক আগে থেকে সে দলের যে কোন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। আমার সাথে অনেকগুলো প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছে, বক্তৃতা করেছে। এসবের ছবিও আছে আমার কাছে। সে দলের দুঃসময়ের সক্রিয় কর্মী। দলের জন্য তার অনেক ত্যাগ রয়েছে। এখন আমি যদি তাকে প্রত্যয়নপত্র না দেই সেটা খারাপ দেখা যাবে। ভবিষ্যতে কেউ আর দল করতে আগ্রহী হবে না। আমরা অনেক কষ্টে একজন কর্মী তৈরি করি। তবে সে একটু পাগল টাইপের। সে ভেতরে ভেতরে হেফাজতের এসব কাজে জড়িত হলেও তা আমার জানা নেই। আনাস মাদানির সাথে বিরোধের পর সে জোনায়েদ বাবুনগীর গ্রুপে যোগ দিয়েছে। তাকে আটকের পর ওসি আমাকে কল করে তার হেফাজত সংশ্লিষ্টতা নিয়ে জানতে চাইলে আমি ওসি সাহেবকে চালান করে দিতে বলেছি।

এ বিষয়ে হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উজায়ের আহমেদ হামিদী হেফাজতে ইসলামের হাটহাজারী উপজেলা শাখার দাওয়াহ বিষয়ক সম্পাদক। এর বাইরে উনি কোনো রাজনীতি করেন কি না আমাদের জানা নেই। হাটহাজারীতে তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এখন আমরা আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে আইনি পদক্ষেপ নেব।’

সোহরাব হোসেন নোমান ওজায়েরকে গ্রেপ্তারের পর থানায় কোন সুপারিশের জন্য আসছিলেন কিনা তা জানতে চাইলেও জানেন না বলে জানান ওসি রফিকুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে গত ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় তাণ্ডব চালিয়ে থানায় ভাংচুর ও ভূমি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় উজায়ের আহমেদ হামিদীকে হাটহাজারী থানা পুলিশ গত ১২ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে। তাকে পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।

সিএম/এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!