কাতার ও ভারতে বসে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির কলকাঠি নাড়ছে সাজ্জাদ গ্রুপ

গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিয়ে ধোঁয়াশা

চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ হোসেন খান ওরফে সাজ্জাদ ও তার অনুসারী সরওয়ার এবং নুরনবী ওরফে ম্যাক্সনের বিরুদ্ধে বিদেশে বসেই চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুবলীগ ক্যাডার একরাম। বহদ্দারহাটে আট খুনের বহুল আলোচিত ঘটনায় প্রথম আলোচনায় আসেন সাজ্জাদ। এদের মধ্যে সাজ্জাদ ভারতের পাঞ্জাবে আর ম্যাক্সন ও সরওয়ার কাতারে অবস্থান করছেন বলে চট্টগ্রামের পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাদের নাম দিয়ে বিভিন্ন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে চট্টগ্রামের বায়েজিদ-পাঁচলাইশ এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে পুলিশ।

যেভাবে প্রকাশ্যে এল চাঁদার ভাগবাটোয়ারা
গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের দুজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে তাদের হয়রানি করে পাঁচ সন্ত্রাসী— রুহুল আমিন (২১), মো. তুহিন (২৮), সুজন (২৯) জাবেদ ওরফে ভাগিনা জাবেদ (৩১) ও রনি (২০)। চাঁদা না দেওয়ায় ২৩ সেপ্টেম্বর নয়াহাটে ওই ব্যবসায়ীদের একজনের বাড়িতে পেট্রোল বোমাও নিক্ষেপ করে তারা। এ ঘটনার পর চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) রাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ওই পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে বায়েজিদ থানার পুলিশ।

নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (বায়েজিদ বোস্তামি জোন) পরিত্রাণ তালুকদার জানান, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে শিবির ক্যাডার সরওয়ার ও ম্যাক্সন এবং কথিত যুবলীগ নেতা একরামের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এতে উঠে আসে, তারা কাতারে বসে সন্ত্রাসীদের দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চাঁদাবাজি করাচ্ছে।

এছাড়া উজ্জ্বল দেওয়ানজী নামে অপর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের নামে টাকা দাবির মৌখিক অভিযোগ পায় পুলিশ। এ অভিযোগের তদন্তে নেমেও পুলিশ জানতে পারে, সরোয়ার, ম্যাক্সন ও একরাম কাতারে অবস্থান করে গ্রেফতার রুহুল আমিনের মাধ্যমে উজ্জ্বলের কাছ থেকে টাকা চেয়েছে।

ইন্টারপোল নিয়ে লুকোচুরি
চাঁদাবাজির সত্যতা পেয়েই সাজ্জাদ, সরওয়ার ও ম্যাক্সনকে কাতার ও ভারত থেকে গ্রেপ্তার করতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়ে নগর পুলিশের উপ কমিশনারের (বিশেষ শাখা) কাছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চিঠি দিয়েছিলেন বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার। তবে থানা পুলিশের দেওয়া চিঠির মেয়াদ এক বছর পার হলেও ওই তিন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারে এখনও পর্যন্ত ইন্টারপোলের সহযোগিতাই চায়নি পুলিশের নগর বিশেষ শাখা।

২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামে একটি অস্ত্র মামলায় ১৪ বছর কারাদণ্ড পাওয়ার পর শিবির ক্যাডার নুরুন্নবী ওরফে ম্যাক্সন এবং মো. সরোয়ার ওরফে বাবলা। ডানে তাদের মাস্টারমাইন্ড সাজ্জাদ খান।
২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট চট্টগ্রামে একটি অস্ত্র মামলায় ১৪ বছর কারাদণ্ড পাওয়ার পর শিবির ক্যাডার নুরুন্নবী ওরফে ম্যাক্সন এবং মো. সরোয়ার ওরফে বাবলা। ডানে তাদের মাস্টারমাইন্ড সাজ্জাদ খান।

ফলে এখনও অব্যাহত রয়েছে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ারের নামে নীরব চাঁদাবাজি। সাম্প্রতিক সময়ে এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুবলীগ ক্যাডার একরাম। তবে নগর পুলিশের বিশেষ শাখার ডিসি আবদুল ওয়ারিশ জানিয়েছেন, বিদেশে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে নিশ্চিত না হয়েই ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া যায় না। এই তিন শীর্ষ সন্ত্রাসীর অবস্থান নিশ্চিতে কাজ করছেন তারা।

বিদেশ থেকে চাঁদাবাজি চলছে নীরবে
গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপ কমিশনারের কাছে বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একটি বিশেষ পত্র পাঠান। সেখানে উল্লেখ করেন, পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের পূর্ব শহীদ নগর এলাকার আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের পাশে মহিউদ্দীন আলম নামে এক কাতারপ্রবাসীর বাড়ি নির্মাণ কাজে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের নাম দিয়ে মোবাইলে চাঁদা দাবি করা হয়। সাজ্জাদ ভারত থেকে বাড়িওয়ালাকে বলেন, তার দুই অনুসারী ম্যাক্সন ও সরওয়ার কাতারে অবস্থান করছে। তাদের কাতারে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। তবে ওই কাতারপ্রবাসী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর কালা মানিক নামে তাদের অপর এক সহযোগী ফোন দিয়ে মহিউদ্দিন আহমেদের পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়।

এমনকি কাতার প্রবাসী ওই ব্যবসায়ী দেশে আসলে সাজ্জাদের সহযোগী নাজিম উদ্দিন হিরু, গিয়াস উদ্দিন ও নজরুল ইসলাম মুন্না নামে এ তিনজনও ব্যাপক হুমকি দিতে থাকে, যাতে কাতারে পলাতক থাকা ম্যাক্সন ও সরওয়ারকে আশ্রয় ও আর্থিক সহায়তা করার জন্য। যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হয় তাহলে বাড়ির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এঘটনার পর তদন্তে নেমে ঘটনার সত্যতা পান। তারপর পুলিশ এই তিনজনকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেন নগর পুলিশের বিশেষ শাখার মাধ্যমে। তবে সেই আবেদনের এক বছর পার হলেও সেটি আর ইন্টারপোলের কাছে পাঠায়নি নগর পুলিশের বিশেষ শাখা।

ইন্টারপোলের রেড নোটিশের মধ্যেই ভারতের পাঞ্জাবে মহাসমারোহে বিয়ের পিঁড়িতে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ খান।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশের মধ্যেই ভারতের পাঞ্জাবে মহাসমারোহে বিয়ের পিঁড়িতে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ খান।

এ কারণেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ারের বাহিনী। গত এক বছরে তাদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকজন জিডি করলেও বেশিরভাগই নীরবে তা সহ্য করে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা গত ১৯ সেপ্টেম্বর কাতারপ্রবাসী এক ব্যবসায়ীকে কাতার থেকে ম্যাক্সন ফোন করে ৪ লাখ টাকা দাবি করেন। চাঁদার টাকা দিতে না পারলে নগরীর পাঁলাইশ থানার মুরাদপুরে থাকা তার যন্ত্রাংশের দোকান জ্বালিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়। হুমকি পেয়ে গত ৮ মাস ধরে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা করে দুই শিশু ও পরিবারের জীবনের মায়ায় চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন ওই ব্যবসায়ী। তবে এ নিয়ে পাঁচলাইশ থানায় কোনও অভিযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ওসি আবুল কাশেম ভূইয়া।

পাঞ্জাবে বিয়ের পিঁড়িতে সাজ্জাদ, কাতারে ম্যাক্সন ও সরওয়ার
শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ খান ওরফে এইট মার্ডারের সাজ্জাদ বর্তমানে ভারতের পাঞ্জাবে পালিয়ে আছেন বলে জানা গেছে। তিনি সেখানে গিয়ে এক ভারতীয় নারীকে বিয়েও করেছেন। অন্যদিকে ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্ত হয়ে দেশে কিছুদিন অবস্থান করলেও এক মাসের মধ্যেই কাতারে চলে যায় সাজ্জাদের দুই সহযোগী ম্যাক্সন ও সরওয়ার। ওই সময়ে ম্যাক্সন ও সরওয়ারের জামিনের বিষয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ নগর পুলিশকে জানালেও তাতে তাদের কোনও আপত্তি ছিল না। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে আর তৎকালীন বায়েজিদ থানার ওসির নীরব সম্মতিতে দেশে কিছুদিন অবস্থান করেই কাতারে পালিয়ে যান এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানায় ১৫টি মামলা ও ৩টি জিডি রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

যেভাবে চলছে চাঁদাবাজি
জানা যায়, নগরীর মুরাদপুর, বিবিরহাট এবং নয়ারহাট এলাকায় কিছু ব্যবসায়ী রিকন্ডিশন (ব্যবহৃত) গাড়ির যন্ত্রাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এনে বাংলাদেশে পাইকারি এবং খুচরা বিক্রি করে। শিবির ক্যাডার ম্যাক্সন ওইসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদার এসব টাকা সংগ্রহ করছে ম্যাক্সন-সরওয়ারের ৩টি গ্রুপের অন্তত ২০ জন সদস্য। তারা চাঁদার টাকা সংগ্রহ করে একটি অংশ রেখে বাকি টাকা কাতারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশে থাকা তাদের ওই ৩টি গ্রুপের সদস্যরা মুরাদপুর, বিবিরহাট ও নয়ারহাট কয়লারঘর এলাকা থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেয়। পরে ওই নম্বরগুলো ম্যাক্সন ও সরওয়ারকে দিলে তারা কাতার থেকে ফোন করে ওই ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দেয়। আর ওই সকল ব্যবসায়ীর পরিবার এবং প্রাণের ভয়ে নীরবে তাদের দাবি করা চাঁদা দিয়ে আসছে। কেউ প্রতিবাদ বা আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলেও পড়ছে নানান ঝামেলায়।

বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ার বর্তমানে দেশের বাইরে থেকে ফোন করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের কাছে চাঁদা দাবি করছে। এরকম কয়েকটা অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছি। তবে কোনও অগ্রগতি জানা নেই এই মূহুর্তে।’

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে ওসি বায়েজিদ বলেন, ‘সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ারের সহযোগী যারা দেশে থেকে তাদের চাঁদাবাজিতে সহযোগিতা করছে তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর। তবে তারা বারবার অবস্থান করায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে নগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপ কমিশনার আব্দুল ওয়ারিশ খান বলেন, ‘শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ার কোথায় আছে সেটা আমরা সুনির্দিষ্ট করে নিশ্চিত নই। তবে লোকমুখে শুনেছি তাদের মধ্যে সাজ্জাদ ভারতে আর ম্যাক্সন ও সরওয়ার কাতারে আছে। থানা পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাইলেও একেবারে সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিশ্চিত না হয়ে ইন্টারপোলের কাছে সহযোগিতা চাওয়া যায় না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!