চট্টগ্রামে এসে মুগ্ধতা ছড়ালেন ওপার বাংলার মুনমুন

হে উদাসীন পৃথিবী, আমাকে সম্পূর্ণ ভুলবার আগে, তোমার নির্মম পদপ্রান্তে আজ রেখে যাই আমার প্রণতি— কবিগুরু রবিঠাকুরের ‘পৃথিবী’ কবিতার অংশবিশেষ দিয়েই কবিতার অবগাহন শুরু করেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী মুনমুন মুখার্জী।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যে ৭টা। বঙ্গবন্ধু বাচিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগরের আয়োজনে নগরীর অভিজাত হোটেল রেডিসন ব্লু বে ভিউ’র মেজবান হলে বসেছিল মুনমুন মুখার্জীর একক আবৃত্তির আসর। কানায় কানায় ঠাঁসা ছিল মিলনায়তন। চেয়ারে জায়গা না পেয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দর্শক-শ্রোতা। অপেক্ষা একটাই। কখন মুনমুন মুখার্জী মঞ্চে উঠবেন। অতঃপর উপস্থাপিকা মুমতাহিনা তাবাসসুম মালিহা’র ঘোষণায় মঞ্চে এলেন তিনি। শোনালেন একের পর এক ভালোবাসার কবিতা। অনুরোধ রাখলেন ভক্তদের।

প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা,আন্দোলন, সংগ্রাম-প্রতিবাদ— প্রত্যেকটি বিষয়ের আলাদা ব্যঞ্জনার কবিতাগুচ্ছ সুনিপুনভাবে যার জাদুকরী কন্ঠে ধরা দেয় তিনিই মুনমুন মুখার্জী। তাঁর কণ্ঠের এমন ভালোবাসায় এবার মুগ্ধ হলো চট্টলবাসী। চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতন ‘প্রণতি গ্রহণ করো ‘ শিরোনামে মোহাবিষ্ট করে ইটপাথরের জঞ্জালে ভরা শহরে এসে জাদুকরী কন্ঠে জয় করে গেলেন হলভর্তি দর্শক-শ্রোতার হৃদয়।

রবিঠাকুরের ‘বীরপুরুষ, আরণ্যক বসুর ‘মনে থাকবে’, জয় গোস্বামীর ‘টিউটোরিয়াল’, তসলিমা নাসরিনের ‘এমন ভেঙেচুড়ে কেউ ভালোবাসেনি’, শুভ দাশ গুপ্তের ‘মেঘ বললো যাবি’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘সেই গল্পটা’। টানা দু ঘন্টা একে একে হলভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের আবৃত্তি শুনিয়েছেন প্রায় ডজনখানেকেরও বেশি কবিতা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভালোবাসি ভালোবাসি কবিতার ‘যেখানেই যাও যেভাবেই থাকো, না থাকলেও দূর থেকেই ধ্বনি তোল ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি’— চরণগুলো বলে থামতেই দর্শকসারিতে থাকা ভক্তরা সমস্বরে চিৎকার করে বললেন— আমরাও ভালোবাসি। এরপর তিনি যখন কবি সৃজা ঘোষের ‘বছরচারেক পর’ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, মেজবান হল মিলনায়তনে তখন সুনসান নিরবতা। চোখ মুছতেও দেখা গেল অনেককে। টানা দুই ঘণ্টা যেন মুনমুনে বুঁদ সবাই। কবিতার যাদুছলে হলভর্তি দর্শকদের মোহবিষ্ট করে রাখেন এই শিল্পী।

তাঁর কণ্ঠের জাদু ডিঙিয়ে গেছে সীমান্তের কাঁটাতার। রবীন্দ্রনাথ- নজরুল থেকে শুরু করে তসলিমা নাসরিন, জয় গোস্বামী বাদ যাননি কেউই। ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার ১৬ আসামির ফাঁসির রায়ের সংবাদকে উৎসর্গ করে একইসাথে পড়েছেন চট্টগ্রামের কবি সৌমেন অনন্তের ‘সেই মেয়েটা’ কবিতাটি। মুনমুন মুখার্জী যখন আশীষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভাগ মানি না দাগ মানি না, কবিতার ভাগ মানি না দাগ মানি না, বাংলা আমার এক— চরণ দুটি আবৃত্তি করছিলেন তখন যেন চোখের মানসপটে তুলে ধরা হয়েছিল কাঁটাতারে দেশ ভাগ হলেও আকাশ মেঘ, পাখিদের কোন দেশ হয় না। ভাষার কোন দেশ হয় না।

মুনমুন মুখার্জী কবিতায় বলেছেন গল্প। জমিয়েছেন প্রেমময় আড্ডা, ভালোবাসা। আবৃত্তির ফাঁকে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মুনমুন মুখার্জী বলেন, ‘এ আয়োজনটা সত্যি বিশেষ। বাংলাদেশে আসা এ নিয়ে চতুর্থ বার। তাই আবেগটা একটু বেশি। আমি ভারত বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই আবৃত্তি করেছি। কিন্তু প্রথমবারের মতো অভিজ্ঞতা হলো পাঁচ তারকা হোটেলেও এমন আবৃত্তির আয়োজন আর হলভর্তি দর্শক শ্রোতা কবিতার প্রেমে। এই বিষয়টি আমাকে অভিভূত ও মুগ্ধ করেছে বলে চট্টগ্রামের দর্শকদের প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।’

অনুষ্ঠানে মুনমুন ছাড়াও আবৃত্তি পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আহকাম উল্লাহ, জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী রাশেদ হাসান, দেবাশীষ রুদ্র ও হাসান জাহাঙ্গীর।

বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বাচিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধক ছিলেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আহকাম উল্লাহ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রামের ভারতীয় সহকারী হাই-কমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জি, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, জেলা শিল্পকলা একাডেমির যুগ্ম-সম্পাদক হাসান জাহাঙ্গীরসহ নগরীর সংস্কৃতিজগতের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ।

এসআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!