সিরিয়াল বাণিজ্য, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কাছে জিম্মি লাইটার জাহাজের ব্যবসা

চট্টগ্রামের বর্হিনোঙ্গরে মাদার ভেসেল থেকে আমদানি পণ্য খালাস করতে ব্যবহৃত হচ্ছে লাইটার জাহাজ। এসব জাহাজগুলোতে পণ্য বোঝায় করতে হলে নিয়ম অনুযায়ী ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) থেকে সিরিয়াল নিতে হয়। সিরিয়াল পেলে পণ্য খালাসের অনুমতি পায়।

অন্যথায় সিরিয়াল বা ভাড়া না পেলে জাহাজ অলস বসে থাকছে মাসের পর মাস। এতে প্রতিটি জাহাজের পেছনে দৈনন্দিন যে খরচ রয়েছে, তা নির্বাহ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে জাহাজ মালিকদের। অনেকে শ্রমিকের বেতন, অনেকের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছেন জাহাজ। সংকট মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়াও হয়ে গেছেন অনেকেই।

অভিযোগ রয়েছে, লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আওতায় রয়েছে অন্তত ১২০০ জাহাজ। ডব্লিউটিসি নামে সংগঠনের কনভেনার নুরুল হক হলেও সেখানে একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকরা। ওই সিন্ডিকেটের মূল ভূমিকায় রয়েছেন বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের (বিসিভিওএ) নির্বাহী সদস্য ও বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এ কে এম সামছুজ্জামান রাসেল। তার ইশারায় চলছে ডব্লিউটিসি থেকে পণ্য খালাসের সিরিয়াল বা ভাড়ার অনুমতি।

এছাড়া কোনো জাহাজ মালিক ডব্লিউটিসির অনুমতি ছাড়া সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে পণ্য খালাসের চুক্তিবদ্ধ হলে সেখানে বাধাগ্রস্ত করেন ওই সিন্ডিকেট। আমাদানিপণ্য খালাস কার্যক্রম একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় আছে ওই সিন্ডিকেট। এতে বেকায়দায় পড়েছেন বেশির লাইটার জাহাজ মালিকরা।

অভিযোগ সূত্রে আরও জানায়, ডব্লিউটিসির কোনো নেতা বা জাহাজ মালিকরা ওই নেতা (রাসেলের) কথায় দ্বিমত পোষণ করলে তাদেরকে নানা হয়রানি করাসহ বন্ধ করে দিচ্ছে পণ্য খালাসের কার্যক্রম। অনেকেই ওই সংগঠনের সদস্যভুক্ত না হলেও নেতাদের ম্যানেজ করে নিয়মিত সিরিয়াল দিচ্ছে ওই সিন্ডিকেট। এসব অবৈধ সিরিয়াল বাণিজ্য করে বছরে আয় করছে তারা শত কোটি টাকা।

এদিকে অভিযোগটি মিথ্যা দাবি করছেন ডব্লিউটিসির কনভেনার নুরুল হক। তিনি বলেম, এ অভিযোগ অপ্রাসঙ্গিক। এক শ্রেণী লোকজন মিথ্যাচার করছে।

একাধিক জাহাজ মালিক জানান, গত দুই বছর ধরে চলছে এই অবৈধ সিরিয়াল বাণিজ্য। আগে প্রতিমাসের এক বা একাধিক পণ্য খালাসের ট্রিপ পেতেন জাহাজ মালিকরা। সেখানে সংগঠনের সদস্যভুক্ত না হয়েও অনেকে পাচ্ছেন নিয়মিত সিরিয়াল। এককথায় পণ্য খালাস করতে হলে ডব্লিউটিসির অনুমতি লাগবে। তাদের কথা মতো না হলে হয়রানিসহ জটিলতা তৈরি করে খালাস কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে।

তারা আরও জানায়, নিয়মিত জাহাজের সিরিয়াল না পেয়ে বাড়ছে মালিকদের ব্যয়ের বোঝা। জাহাজের দৈনন্দিন জাহাজের খরচ, কর্মচারি-কর্মকর্তাদের খরচ, ব্যাংক ঋণসহ নানা খরচের ভার পড়ছে প্রতিমাসে। এতে অনেকেই জাহাজ বিক্রি করে ব্যবসায়ই গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার ব্যাংক ঋণের ভারে দেউলিয়া হয়েছেন অনেকেই।

সূত্র বলছে, নিয়মের বাইরে গিয়ে অন্তত ২০০ লাইটার জাহাজ সরাসরি পণ্য খালাস করছে। এতে প্রকৃত জাহাজ মালিকরা সিরিয়াল পাচ্ছে না। এছাড়া সম্প্রতি বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো তাদের নিজস্ব লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করছে। যার ফলে একদিকে সিন্ডিকেটের কোটা অন্যদিকে শিল্প গ্রুপদের কাছে লাইটার জাহাজের চাহিদা কমে যাওয়ায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন জাহাজ মালিকরা।

তিন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। তার মধ্যে রয়েছে— বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের (বিসিভিওএ), কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিওএবি) এবং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভিওএসি)। এই সংগঠনের আওতায় অন্তত ১২০০ লাইটার জাহাজ রয়েছে।

জানতে চাইলে মর্ডাণ লজিস্টিক কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী পারভেজ আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি বেশির ভাগ ফ্যাক্টরি তাদের নিজস্ব লাইটার জাহাজ দিয়ে মাল খালাস করছে। যার কারণে একটু সংকট তো হবে। ডব্লিউটিসি থেকে জাহাজ নিলে রেট পড়ছে ৫৮৩ টাকা। বাইর থেকে নিলে আরও ৫০ থেকে ১০০ টাকার রেট কম পাচ্ছে আমদানিকারকরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহও বেশি। উন্মুক্ত বাজারে যে যার মতো করে ব্যবসা করবে এটা স্বাভাবিক। কেউ তো লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না।’

সামছুজ্জামান রাসেলের বিরুদ্ধে জাহাজ মালিকদের নানা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আরও বলেন, ‘আমিও শুনেছি এরকম অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু আমদানিকারক ও শিল্প মালিকদেরও অভিযোগ রয়েছে। তিনি নাকি তার সংগঠনের লোকজনকে পণ্য খালাসের সিরিয়াল দিচ্ছেন, ডব্লিউটিসি মেম্বাররা জাহাজের সিরিয়াল পাচ্ছেন না।’

জানতে চাইলে মেরিন সার্ভিস ট্রেডাসের সত্ত্বাধিকারী প্রদীপ চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উন্মুক্ত বাজারে এখন বিভিন্ন কোম্পানি নিজস্ব লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করছেন। সেখানে তো ডব্লিউটিসির সিরিয়াল থেকে তো নিচ্ছেনা তারা। তারা কেন সিরিয়াল নিবে? ডব্লিউটিসি কি কোনো সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কোনো সংস্থা যে তাদের নিয়ম মানতে হবেই। আমি দুই টাকা কম দিয়ে ভাড়া নিবো, সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। ডব্লিউটিসির নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে তো আমি ব্যবসা করতে পারবো না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এ কে এম সামছুজ্জামান রাসেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তিনি ঢাকা আছেন বলে প্রতিবেদককে চট্টগ্রাম আসলে কথা বলবেন জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কনভেনার নুরুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা রাসেলের বিরুদ্ধে অপবাদ দিচ্ছেন, তারা ভুয়া। রাসেল রাইট পয়েন্টে রয়েছে।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!