সমুদ্র পরিবহন খাতের আজ ঘোর দুর্দিন

ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছে প্রতিষ্ঠিত শিপিং কোম্পানিগুলো

আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন সেক্টরে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে দিন দিন কমছে জাহাজের সংখ্যা। এর ফলে কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। সরকারি ও বেসরকারি মেরিন একাডেমি এবং ইন্সটিটিউট থেকে পাশ করে বেকার বসে আছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।

সর্বশেষ ২০১৪ সালেও সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন জাতীয় পতাকাবাহী জাহাজ ছিলো ৬৩টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে জাহাজের সংখ্যা কমে এখন ৪১টি। কমে গেছে ২২টি জাহাজ। এর মধ্যে সম্প্রতি বিএসসির (বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন) বহরে নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে পাঁচটি । আরো একটি জাহাজ যুক্ত হবে ৩০ এপ্রিল।

সমুদ্র পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিপিং কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে। এইচআরসি শিপিং ১০টি জাহাজ পরিচালনা করলেও এখন তাদের একটি জাহাজও নেই। সিএলএ কন্টেইনার লাইনারের ১০টি জাহাজের মধ্যে টিকে আছে ২টি। সিলভিয়া শিপিং-এর প্রায় ১০টি জাহাজের মধ্যে এখন একটিও নেই। এছাড়া রতনপুর স্টিল, ট্রান্স ওশান ক্রিস্টাল শিপিং সহ অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান জাহাজ পুরাতন হওয়ায় তা স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিয়ে নতুন কোন জাহাজ ক্রয় করেনি।

সরকারি শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন চৌধুরী জাহাজের বর্তমান সংখ্যার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না দিলেও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসআর শিপিং, বসুন্ধরা গ্রুপ, ক্রাউন সিমেন্ট, আকিজ গ্রুপ, ভ্যানগার্ড শিপিং, মেঘনা শিপিংসহ বিভিন্ন শিপিং কোম্পানির বেসরকারি পর্যায়ে জাতীয় পতাকাবাহী ৩৪টি জাহাজ আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে।

সমুদ্রপথে দিন দিন বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জাহাজ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, একটি জাহাজ সমুদ্রে চালু অবস্থায় দৈনিক খরচ পড়ে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার ডলার। যেসব প্রতিষ্ঠান জাহাজ কিনেছে, তাদের অনেকের এ খাতে ব্যবসার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর যেসব লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয় তারাও তেমন দক্ষ নয়। তাছাড়া কার্গো জাহাজ না পাওয়া, পর্যাপ্ত ভাড়া না পাওয়া, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই খাত। ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বেশিরভাগ শিপিং কোম্পানিই।

বাংলাদেশ সি-ফ্যারার্স ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ১৯৭৮-৭৯ সালে বাংলাদেশের নাবিকের সংখ্যা ছিলো ১২ হাজার। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক জাহাজে কর্মরত অবস্থায় থাকতো সাত হাজার ৫০০। বর্তমানের নাবিকের সংখ্যা তিন হাজার ৭০০। এর মধ্যে জাহাজে কর্মরত অবস্থায় আছে মাত্র এক হাজার ৩৫০ জন নাবিক।

সূত্র জানায়, জাহাজের সংখ্যা কমার কারণে কর্মসংস্থানে ধস নামার পাশাপাশি নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট এবং নাবিকদের নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ কমে গেছে। অনেক ম্যানিং এজেন্ট (নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট) নাবিক নিয়োগের মাধ্যমে মানব পাচারের সাথে জড়িত ছিল। এর পাশাপাশি অদক্ষ লোকদের ক্যাপ্টেনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার কারণে তাদের হাতে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে অনেক জাহাজ। অনেক নাবিক বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজে কাজ করতে গিয়ে জড়িত হয়েছে নানা অনৈতিক কাজে। জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। এসব কারণে বিদেশী জাহাজগুলো এখন আর বাংলাদেশের নাবিকদের নিয়োগ করতে চায় না।

জাহাজে কর্সমংস্থান না থাকায় বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন মেরিন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাহাজের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় ক্রু পদে যোগ দিতে যাওয়া এক যুবক বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যামিক পাশ করার পর ২০১৩ সালে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অপেক্ষায় আছি জাহাজে যোগ দেওয়ার জন্য। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ২০১৭ সালে রোস্টারভুক্ত হয়েছি। এখন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ধর্না দিচ্ছি সরকারি শিপিং অফিসে।’

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে সাইন অন এবং সাইন অফ করতে আসা জাহাজের বিভিন্ন পদে চাকরিরত তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একবার জাহাজ থেকে নামার পর দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এ সময় কাজ না পেয়ে তারা চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তারা ক্ষোভের সাথে জানান, দিন দিন জাহাজে কাজের পরিধি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্র পরিবহন সেক্টরে চরম বিপর্যয়ের শংকা দেখছেন তারা।

নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট হক এন্ড সন্স লিমিটেডের উর্ধতন মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নাবিক রিক্রুটের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়া। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান শিপিং সেক্টর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। শিপিং সেক্টরের উন্নতির স্বার্থে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নাবিকদের কাজের ক্ষেত্রও কমে যায়। বিএসসিতে ইতোমধ্যে পাঁচটি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। আগামী ৩০ এপ্রিল যুক্ত হবে আরো একটি জাহাজ। নতুন যুক্ত জাহাজের ফলে নতুন করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এ বিষয়ে সরকারি শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তার দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!