সবুজ নগর/ দীঘির জলে নতুন চট্টগ্রামের স্বপ্ন

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পাঁচ দীঘিকে ঘিরে অন্যরকম এক স্বপ্নজাল বুনছেন একদল তরুণ স্থপতি। প্রায় অর্ধকোটি মানুষের বসবাস এ নগরীতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে যেমন বাড়ছে জনসংখ্যা, তেমনি বাড়ছে আকাশচুম্বী ভবন। এসব কারণে নগরজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের সমাহার। এমনকি দ্রুত নগরায়ন এবং বেগবান অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে খেলার মাঠ-পুকুর-দীঘি-জলাশয়ই শুধু হারাচ্ছে না, একইসঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার খোলা আকাশও।

অপরিকল্পিত নগরায়ন একসময়কার প্রাণবন্ত এলাকাগুলোকে সাধারণ নাগরিকদের জন্য অব্যবহৃত, অবৈধভাবে দখলকৃত ও মৃত স্থানে পরিণত করছে। একই সাথে এসব স্থান ব্যবহৃত হচ্ছে অপরাধ ও অসামাজিক কার্যক্রমের আধার হিসেবে। এরকম নগরীর পাঁচ দীঘিকে ঘিরে চট্টগ্রামের ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’ বেশ কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরের এসব নাগরিক পরিসর পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যমে নান্দনিক নাগরিক পরিসর নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই পাঁচটি দীঘি হল আসকার দীঘি, জোড়া দীঘি, ভেলুয়ার দীঘি, রাণীর দীঘি এবং আগ্রাবাদ ঢেবার পাড়।

স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিওর নেপথ্যের রূপকাররা
স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিওর নেপথ্যের রূপকাররা

নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি জেরিনা হোসেইনের তত্ত্বাবধানে স্থপতি অরিত্র দে অর্ক এবং স্থপতি অর্চিষ্মান দাশের পরিকল্পনায় অভিজ্ঞ স্থপতি, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, ভাস্কর, প্রকৌশলী ও স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত একটি স্থাপতিক দল—‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’। এ দলে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক উর্মি চৌধুরী। দলে আরো রয়েছেন চুয়েটের স্নাতক ও অস্ট্রেলিয়ার ডিকেন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করা মাহমুদা চৌধুরী এবং আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও চীনের উহাইন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা সৈয়দ সুলতান আহমেদ।

তাদের মতে, কিছুটা নাগরিক দায়বদ্ধতা এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরকে একটি সবুজ, আধুনিক, নিরাপদ ও নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকে ‘স্বাপ্নিক’ এর যাত্রা।

স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিওর স্থপতি অর্চিষ্মান দাশ বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও সুন্দর দীঘি। যার সবগুলোই বর্তমানে নগরের সাধারণ মানুষের অগম্য এবং অপরিকল্পিত আবাসনের মাধ্যমে অপরিষ্কার জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে। অন্যদিকে নগরে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা, পানিবাহিত রোগবালাই এর মত নানামাত্রিক নাগরিক দুর্ভোগ। ইট-কনক্রিটের ভীড়ে শহরের মানুষের যেখানে পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় কাটানোর স্থান দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। সেখানে এসব দীঘির পারিপার্শ্বিক এলাকা রয়েছে অবৈধ দখলদারদের দখলে।’

এসব জলাশয় ও দীঘিকে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করে পরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে নগরের সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ও উপভোগ্য নান্দনিক স্থানে পরিণত করার লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করছে ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’।

উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন যেসব দীঘিকে ঘিরে স্বপ্নজাল বুনেছে ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’, তার মধ্যে রয়েছে আসকার দীঘি, জোড়া দীঘি, ভেলুয়ার দীঘি, রাণীর দীঘি এবং আগ্রাবাদ ঢেবার পাড়। এসব জলাধার এবং পারিপার্শ্বিক স্থানে নির্মাণ করা হবে সবুজ পরিবেশ, ফুলের বাগান, আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, বিশ্রামের স্থান, হাঁটার জন্য প্রশস্থ ওয়াক-ওয়ে, খেলার জায়গা, আধুনিক শৌচাগার, খাওয়ার স্থান, অস্থায়ী দোকান, ফ্রি ওয়াইফাই জোন এবং আ্যাম্ফিথিয়েটার।

এছাড়াও নৌকা চলাচল, মাছ ধরা এবং উৎসবকেন্দ্রিক আয়োজনের মাধ্যমে প্রাণের সঞ্চার করা হবে এসব দীঘিকে। আশপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে নগরের মধ্যে উন্মুক্ত ও দৃশ্যমান করা হবে। নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য সম্পূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রিত এবং পর্যবেক্ষণ করা হবে সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা। থাকবে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা। নাগরিক ব্যস্ততার ফাঁকে পরিবার নিয়ে সময় কাটাতে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, বিভিন্ন উৎসব পালন এবং নগরবাসীর সার্বিক চিত্তবিনোদনের স্থান নির্মাণের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা হবে এইসব দীঘির ইতিহাস ও ঐতিহাসিক মূল্যবোধ। প্রাথমিক জরিপ এবং ডিজিটাল সার্ভে শেষ করার পর নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’ এর তরুণ স্থপতিরা।

স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিওর স্থপতি অরিত্র অর্ক বলেন, ‌‘জলদীঘি’ শিরোনামে আন্তর্জাতিকমানের এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম শহরের পাঁচটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় দীঘি সরেজমিন জরিপ ও ব্যাপক নিরীক্ষণের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ের কাজ গত মার্চ থেকে শুরু হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান ও নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এরপর আয়োজন করা হবে একটি উন্মুক্ত প্রদর্শনীর। এই প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ জানানো হবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের।’

‘এই প্রদর্শনী ও আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্টরা এই প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব মতামত, পরামর্শ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য বাধা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে নির্দেশনা দেবেন। ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’র লক্ষ্য সকলকে নিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা।’

স্থপতি অরিত্র অর্ক আরো বলেন, ‘চূড়ান্ত নকশা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত হওয়ার পর ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টাডিও’ এর তত্ত্বাবধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে পাল্টে যাবে শহরের সার্বিক দৃশ্যপট। ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’ চট্টগ্রাম শহরকে একটি সবুজ, নিরাপদ ও নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নটা ছড়িয়ে দিতে চায় সবার মাঝে, স্বপ্নটা বাস্তবে রূপান্তরিত করতে চায় সবাইকে সঙ্গে নিয়েই।’

এছাড়াও ‘স্বাপ্নিক ডিজাইন এন্ড রিসার্চ স্টুডিও’ এর পরিকল্পনা ও নকশায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়নের পথে রয়েছে ‘আউটার স্টেডিয়াম উন্নয়ন পর্ব-১’ এর কাজ। নগরীর কাজির দেউড়িতে অবস্থিত আউটার স্টেডিয়ামের উত্তর ও পুর্ব পাশে নান্দনিক নাগরিক পরিসর নির্মাণ ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে প্রথম পর্বে।

এখন চলছে দ্বিতীয় পর্বের কাজ। এর আওতায় ঢেলে সাজানো হবে আউটার স্টেডিয়ামের ভেতরের মাঠকে। নির্মাণ করা হবে সবুজ ঘাসে ঢাকা খেলার মাঠ, হাটার জন্য প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাচ্চা ও বড়দের খেলার জায়গা, আধুনিক শৌচাগার, বিশ্রাম ও ব্যায়ামের স্থান, খাওয়ার স্থান এবং একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার।

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!