সন্তানের মুখ দেখার আগেই ছাড়লেন পৃথিবী, নেপথ্যে মাদক ও চোরা স্বর্ণের মোহ

ইঞ্জিনিয়ার ছেলে কেন মাদক ব্যবসা করবে, প্রশ্ন পরিবারের

আর মাস দুয়েক পরেই হয়তো অনাগত সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার করতেন তিনি। কিন্তু মাদক, স্বর্ণের লোভে জীবনটাই জলাঞ্জলি সদ্য বিবাহিত সুমনের। ঘরে বেঁধে রেখে তিন ব্যক্তির নির্যাতনে প্রাণ গেল ২৮ বছরের এই যুবকের।

জানা গেছে, পারিবারিকভাবেই ছোটবেলা থেকে স্বর্ণ ব্যবসায়ে আগ্রহ সুমনের। তার বাবা নগরীর হাজারী গলির স্বর্ণ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা করতে গিয়ে পরিচয় হয় রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকার মাদক ব্যবসায়ী মফিজুর রহমান দুলুর (৫৬) সঙ্গে। দুলুর সঙ্গে সখ্যতার পর সুমনের ব্যবসার পরিধি স্বর্ণ থেকে বেড়ে মাদকে গড়ায়। মাদকসেবনের জন্যও দুলু-সুমনরা ভাড়া নেন আলাদা রুম। প্রতিবারের মতোই সেই ঘরে নেশা করতে গিয়েই প্রাণ হারান সুমন। সারারাত তাকে বেঁধে নির্যাতন ও শেষ দিকে হাতের নখ পর্যন্ত উঠিয়ে নেয় দুলু ও তার অপর দুই সঙ্গী। পরে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রাণ যায় সুমনের।

সোমবার (২৭ নভেম্বর) গভীর রাত ৩টার দিকে ঘটে এই ঘটনা। যদিও ঘটনার দুই ঘণ্টার মধ্যে সুমন হত্যাকাণ্ডে জড়িত তিনজনকেই গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালী থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তার তিন আসামি হলেন মফিজুর রহমান দুলু (৫৬), মো. মামুন (৩৮) ও নুর হাসান রিটু (২৮)।

হত্যার পেছনের কারণ

পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর আসামিরা জানান, সুমন ও দুলুর মধ্যে স্বর্ণ এবং মাদকের ব্যবসা ছিল। ব্যবসার একপর্যায়ে সুমনের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা পাওনা হন দুলু। সেই বিষয়েই দুলু-সুমনের সম্পর্কে ফাটল ধরে।

দুলু-সুমনের খারাপ সম্পর্কের মধ্যে দু’জন ব্যক্তি রিয়াজউদ্দিন বাজারে দুলুর ব্যবসায়িক অফিসে তল্লাশি চালায় এবং মারার পরিকল্পনা করে। যদিও সেই দুই ব্যক্তির পরিচয় এবং তাদেরকে পাঠিয়েছে সেই সম্পর্কে কোনো তথ্যই জানা ছিল না দুলুর। তবে এই ঘটনায় যথেষ্ট ক্ষিপ্ত হন তিনি।

এই ঘটনার পর দুলুকে স্বর্ণ কেনার জন্য টেকনাফ যাওয়ার প্রস্তাব দেন সুমন। এই কথা অপর আসামি মামুনের কানে গেলে তিনি সুমনের প্রস্তাবটি ভিন্নভাবে দুলুর কাছে উপস্থান করেন। তিনি বলেন, দুলুর অফিসে যে দুই লোক তল্লাশি ও তাকে মারার চেষ্টা করেছে সেগুলো সুমনের। এছাড়া এবারও স্বর্ণ কেনার নামে টেকনাফ নিয়ে গিয়ে দুলুকে মারার পরিকল্পনা করছে সুমন।

মামুনের এই ‘কানকথা’ বিশ্বাস করে সুমনের ওপর চওড়া হন দুলু। এরপর সুমনকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।

উপড়ে ফেলা হয় হাতের নখ

বরাবরের মতো রোববার (২৬ নভেম্বর) সুমন রিয়াজউদ্দিন বাজারের মুরগিহাটা লেনের সুপার মার্কেটের দু’তালার ভাড়া বাসাতে নেশা করতে যান। সেখানে তাকে জিম্মি করেন দুলু, মামুন ও নূর হোসেন রিটু। কোন দু’জন লোককে অফিসে তল্লাশির জন্য পাঠিয়েছে—তা বারবার জানতে চান দুলু। কিন্তু এ ঘটনার কোনো তথ্য জানা নেই বলে জানান সুমন। কিন্তু এরপরও তার কথা বিশ্বাস না করে হাত-পা বেঁধে প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার রড দিয়ে মারধর করেন তিনজন। মারধরের পরও কোনো তথ্য না দেওয়ায় তার হাতের নখ উপড়ে ফেলেন তারা। সর্বশেষ সুমনকে উলঙ্গ করে লোহা দিয়ে পেটানোর কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়।

অধিক ক্ষত ও রক্তক্ষরনে ক্রমশ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন সুমন। গত ২৬ নভেম্বর রাতে সুমনকে জিম্মি করা হলেও মৃতপ্রায় অবস্থায় পরিবারের হাতে হস্তান্তর করা হয় ২৭ নভেম্বর মধ্য রাতে।

সুমনকে নিয়ে যেতে ফোন করা হয় তার মাকে

২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নির্যাতনের ফলে যখন সুমনের অবস্থা বেগতিক, তখন তার পরিবারকে ফোন করে জানানো হয়, সুমনের সঙ্গে ব্যবসায়িক কারণে দুলুর মনোমালিন্য হয়েছে। দুলুর সঙ্গে বেয়াদবি করায় সুমনকে শাসনের জন্য হালকা মারধর করা হয়েছে। সে সুস্থ আছে, তাই কেউ যেন এসে সুমনকে যাতে নিয়ে যান। ভাগিনাকে আনতে গিয়ে মূর্মুর্ষ অবস্থায় মেঝেতে পরে থাকতে দেখেন মামা। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। মেডিকেলে যাওয়ার পথেই প্রাণ হারান সুমন।

‘ইঞ্জিনিয়ার ছেলে কেন মাদক ব্যবসা করবে’

স্বর্ণ ব্যবসায়ী শ্যামল সাহার দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় সুমন। কিছুদিন আগেই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হন তিনি। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় দ্রুত বিয়েও করানো হয় সুমনকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হলেও নিয়মিত বাবার স্বর্ণের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন সুমন। এরকম একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলে কিসের অভাবে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত হবে? এখানে হয়তো কোনো মিথ্যা তথ্যর ভিত্তিতে সুমনের নামটা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, দাবি তার পরিবারের।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!