শ্বাসনালী পুড়ে গেছে অর্ধশত মানুষের, চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেই দরকারি চিকিৎসা

আইসিইউ সাপোর্ট অপ্রতুল, সংকট অক্সিজেনেরও

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপো বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৬ নম্বর বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন ৯ জন। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪০ জন।

৩১ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিদগ্ধদের বেশিরভাগেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। কিন্তু শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসা চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেই।

জানা যায়, পেট্রোল বা কোনো দাহ্য পদার্থ দিয়ে যদি আগুন লাগানো হয়, কিংবা গ্যাস থেকে আগুন লাগলে বা বদ্ধ কোনো জায়গায় আগুন লাগলে শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। শ্বাসনালীর পোড়াটা সরাসরি ফুসফুসে প্রভাব সৃষ্টি করে বলে এই পোড়া সবচেয়ে মারাত্মক।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রার লিটন কুমার পালিত বলেন, ‘আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি, সেটি একটি নালীর মাধ্যমে ফুসফুসে যায়। এই বাতাসের সঙ্গে ছোট ছোট উপাদান থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এগুলো ফুসফুসে গিয়ে সংক্রমণ সৃষ্টি করে। পরিবেশে বা বাতাসে যে মাইক্রোঅর্গানিজম থাকে সেগুলো চামড়া বা ত্বক ভেদ করে ঢুকতে পারে না। কিন্তু চামড়া পুরো গেলে সেগুলো সহজেই ফুসফুস এবং মাংসপেশিতে সংক্রমণ তৈরি করে।’

এই মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো পোড়া শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে ফুসফুসে সংক্রমণ তৈরি করে। যার কারণে নিউমোনিয়া দেখা দেয়। এ কারণে এটি একটি বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করে বলে জানান তিনি।

লিটন কুমার পালিতের কথার সূত্র ধরে আরও জানা যায়, শ্বাসনালীর মিউকাস মেমব্রেন যখন পুড়ে যায়, তখন দেহের সব প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক জৈবিক ও রাসায়নিক বিপাক-প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় গ্রন্থি, যেমন লিভার, কিডনি, এমনকি সব দেহকোষের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে বার্ন স্ট্রেচ শরীরের সব রাসায়নিক উত্তেজক গ্রন্থির নিঃসরণ আরও দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়। তখন অতি অল্প সময়ে ওই পোড়া রোগীর পুরো শরীর ফুলে-ফেঁপে যায়।

শ্বাসনালী পোড়া রোগীর জন্য সবচেয়ে বড় যেটি দরকার সেটি হলো আইসিইউ সাপোর্ট। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলে আইসিইউ সাপোর্ট অপ্রতুল।

৩১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএম কন্টেইনার গোডাউন বিস্ফোরণের ঘটনায় যতগুলো অগ্নিদগ্ধ রোগী রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগের মুখে নল লাগানো রয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডজুড়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপ্রতুলতা দেখা গেছে। স্বেচ্ছাসেবীরা যারা ওয়ার্ডে কাজ করছেন সবাই ‘অক্সিজেন অক্সিজেন’ বলে চিৎকার করছেন।

রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক ফারহান রোববার (৫ জুন) দুপুর আড়াইটায় বলেন, ‘রোগীদের জন্য অক্সিজেনের দরকার পড়ছে। কিন্তু সিস্টার, ডাক্তারকে ডেকেও আমরা সিলিন্ডার ম্যানেজ করতে পারছি না। ওয়ার্ডে রয়ে গেছে চিকিৎসক সংকটও।’

জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৬ শয্যার এই ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় লোকবল বাড়ানো হয়নি। চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং ফেনী, নোয়াখালী ও সন্দ্বীপ এলাকার লোকজন এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। ২৬টি শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন এখানে রোগী ভর্তি হয় ৬০ থেকে ৭০ জন। আর অতীতে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, ততবারই শ্বাসনালী পোড়া রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা সমস্যা।

বর্তমানে বার্ন ইউনিটে একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন রেজিস্ট্রার ও দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার আছেন। একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকও চিকিৎসা দেন এই ইউনিটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক সময় সার্জারি ওয়ার্ডের একপাশে দগ্ধ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হতো। এরপর ২০০৮ সালে সার্জারি ওয়ার্ডের পাশে ১৩ শয্যার বার্ন ইউনিট চালু করা হয়।

এরপর ২০১২ সালের ৭ জুন হাসপাতালের ছয়তলায় প্রসূতি ওয়ার্ডের পাশে ২৬ শয্যায় উন্নীত করে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটটি স্থানান্তর করা হয়। তবে এই ইউনিটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় ঢাকায় নেওয়ার পথেই মারা যাচ্ছে অনেক রোগী।

এই সীমাবদ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আইসিইউ সাপোর্ট তো সম্ভব না। আর এটা কেন নেই, কেন বারবার বড় কোনো ঘটনা ঘটলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, এটির উত্তর হাসপাতালের পলিসি মেকাররাই দিতে পারবেন। যা নেই তা আর বলে কী হবে?’

আইএমই/ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!