গোপনে ভয়ংকর রাসায়নিক রাখা হয়েছিল সীতাকুণ্ডের ডিপোতে, ধ্বংসলীলার সময়ও তথ্যগোপন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পণ্য মজুদের অনুমতিই ছিল না। এমনকি ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের’ মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদ ছিল— সেই তথ্যও জানানো হয়নি ফায়ার সার্ভিস কিংবা বিস্ফোরক অধিদপ্তরকে। শনিবার (৪ জুন) রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর রাসায়নিক থাকা কয়েকটি কনটেইনারে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ যদি আগে থেকেই অবহিত করতো যে, কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ রয়েছে তাহলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এত কাছে গিয়ে আগুন নেভাতে যেতেন না এবং ডিপোর আশেপাশের লোকদেরও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু মালিকপক্ষ সেই তথ্য গোপন করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানান কন্টেইনারের ভেতরে রয়েছে কাপড়। যদি ডিপো কর্তৃপক্ষ সঠিক তথ্য দিতো, তাহলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হতো বলে দাবি করা হয় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে।

চট্টগ্রাম বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘বিপজ্জনক পণ্য মজুদ করার কোনো লাইসেন্স ও অনুমোদন নেই বিএম ডিপোর। এই ধরনের পণ্য সংরক্ষণ করার জন্য বিশেষ অবকাঠামোর দরকার হয়।’

বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ না জানিয়ে বিপজ্জনক পণ্য মজুদ করায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানা গেছে, অনুমোদন ছাড়াই ডিপোর কন্টেনারগুলো ভর্তি ছিলো আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স কোম্পানির হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে। প্রতিটি জারে ছিলো ৩০ কেজি ওজনের এই ভয়ংকর রাসায়নিক। এই আল রাজি কেমিক্যাল কোম্ম্পানিটিও বিএম ডিপো মালিকপক্ষেরই প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে।

ডিপোতে অনুমোদন ছাড়া রাসায়নিক রাখার বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম মালিক মুজিবুর রহমানকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও তার সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।

হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আসলে কী?

সরল ভাষায়, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হলো উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ— যা উচ্চ তাপে বিস্ফোরণ ঘটায়। মূলত বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই পদার্থ। এছাড়াও রকেটের জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই উচ্চ শ্রেণির বিস্ফোরক। দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতেও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বেশি ব্যবহৃত হয়, এছাড়াও ফার্মাসিটিক্যাল ও রং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই রাসায়নিক।

তবে বিজারকের উপস্থিতিতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মারাত্মকভাবে ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখায় বলে জানান চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. অজয় দত্ত।

তিনি বলেন, যেহেতু এই রাসায়নিক উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় পদার্থ, তাই এটিকে খুব সাবধানতার সাথে সংরক্ষণ করতে হয়। অন্যথায় উচ্চ তাপ বা অন্য কোন মৌলের সাথে বিক্রিয়া করে এটি বিস্ফোরণ ঘটাবে। হয়ত বিএম কনটেইনার ডিপোর যেখানে এটিকে রাখা হয়েছে সেখানে উপযুক্ত জায়গায় এটিকে রাখা হয়নি।

এছাড়াও সেখানে ভেজাল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকতে পারে বলে অনুমান করছেন ড. অজয়। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি আরও বলেন, পিউর হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হলে এত বেশি ক্ষতি করতো না। ওখানে নিশ্চয় অন্যকোন রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত ছিলো। তাই এর বিস্ফোরণের মাত্রা এত ভয়াবহ হয়েছে।

এই রাসায়নিকের দ্বারা মানুষের কেমন ক্ষতি হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. অজয় দত্ত জানান, ক্ষারীয় সব রাসায়নিকই কম বেশি ক্ষতি করে। তবে এই রাসায়নিক পদার্থটি মানুষের ত্বককে বিশেষভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, মানুষের চামড়ার কোষগুলোকে জ্বালিয়ে নষ্ট করে দেয়। এছাড়াও কেউ যদি এই পদার্থটি খেয়ে নেয় বা বাতাসের মাধ্যমে ফুসফুসে যায় তবে সাথে সাথে পাকস্থলী ও ফুসফুসের কোষগুলো জ্বলে যায়। তাই যেসকল ক্ষেত্রে এই রাসায়নিক ব্যবহৃত হয় সেখানে অতি সাবধানতার সাথে এটিকে হ্যান্ডেল করা হয়।

এছাড়াও ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সময় পানি ব্যবহারের ফলে এই রাসায়নিকের বিস্ফোরণের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন রসায়নের এই গবেষক।

মৃত্যু বেড়েছে অসহযোগিতায়

জানা গেছে, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে থাকা আল রাজি কেমিক্যাল কোম্পানির ৩০ কেজির হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডটি ৬০ শতাংশের ছিল। বিশেষজ্ঞদের কারও কারও ধারণা, এই জারে থাকা রাসায়নিকের বাকি ৪০ শতাংশ ভেজাল ছিল।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ফায়ার সার্ভিসের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনার পর বিএম ডিপোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পালিয়ে যান। যদি তারা আমাদের জানাত যে সেখানে এই জাতীয় দাহ্য পদার্থ আছে, তাহলে আমরা পানির পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করতাম। কিন্তু তারা আমাদের সহযোগিতা না করায় আমাদের এতগুলো ভাই মারা গেলো।’

শনিবার (৪ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় ৪৯ জন নিহত ও ২ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ আশপাশের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে ইউনিট আরও বাড়ানো হয়। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের ১৮৩ কর্মী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এছাড়া নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ করছেন।

সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ২৪ একর জায়গায় অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে। এখান থেকে পণ্য রপ্তানির জন্য কনটেইনারগুলো প্রস্তুত করে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। ৩৮ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। ঘটনার সময় সেখানে ৫০ হাজার কনটেইনার ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় অন্তত দুইশ শ্রমিক সেখানে কাজ করছিলেন বলেও জানা গেছে।

বিএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!