শাশুড়িকে বালিশচাপায় খুন, রাতভর চোর-পুলিশ খেলা শেষে গ্রেপ্তার মেয়ের জামাই

পরিবারের বাকি সন্তানদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই চট্টগ্রামের বন্দর থানার কলসী দীঘি এলাকায় মেয়ের ভাড়া বাসাতেই থাকতেন ৫০ বছরের বৃদ্ধা রুমা আক্তার। সর্বশেষ কোরবানীর ঈদের পর থেকে টানা ছিলেন সেখানে। আর নিজেদের ঘরে শাশুড়ির থাকা মেনে নিতে পারছিলেন না মেয়ের জামাই মো. আজিম(৫৩)। এই কারণে একাধিকবার শ্বাশুড়িতে বকাঝকা এমনকি গায়েও হাত তুলেন তিনি। কিন্তু এরপরও কোনো উপায়ে শাশুড়িকে বাড়ি থেকে বের করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত বালিশচাপায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন মেয়ের জামাই আজিম।

এদিকে হত্যার ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে শাশুড়িকে হত্যার পর গলায় গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে জানালার সঙ্গে বেঁধে রাখেন আজিম। ঘটনার পর পালিয়ে গেলেও পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাননি তিনি। রাতভর নগরীর বিভিন্ন জায়গাসহ কয়েকটি উপজেলায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় ঘাতক জামাইকে।

এই ঘটনা ঘটেছে বন্দর থানার কলসিদীঘির পাড় এলাকার কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরীর ভাড়া বাসার চারতলায়। রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টার দিকে হত্যাকাণ্ড ঘটলেও তা জানা গেছে সন্ধ্যা ৬টার পর। এরপর সন্দেহভাজন মেয়ের জামাই আজিমকে সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) নগরীর ডবলমুরিং থানার সুপাড়ি ওয়ালাপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিকভাবে শাশুড়িকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন বলে জানায় পুলিশ।

পেশায় রাজমিস্ত্রি মো. আজিম কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি কলসিদীঘি এলাকায় ভাড়া থাকতেন। অন্যদিকে নিহত রুমা আক্তার কক্সবাজার ঈদগাঁ এলাকার বাসিন্দা।

বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) খবর পেয়ে আমরা রুমা আক্তারের লাশ উদ্ধার করি। খুন করার পর আজিম মোবাইল বন্ধ করে পালিয়ে যায়। পরে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে প্রায় আট ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে তাকে আমরা গ্রেপ্তার করি। সে খুনের কথা স্বীকার করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং আদালতে পাঠানো হয়েছে।’

নিহতের নাতনি জান্নাতুল নাঈমা বলেন, ‘আমার মামার বাড়ির বাকিদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় নানি বেশিরভাগ সময় আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। কিন্তু বিষয়টি আমার বাবা পছন্দ করতেন না। তিনি কয়েকবার আমার নানিকে কক্সবাজার আমার মামার কাছে পাঠিয়েও দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমার মা প্রতিবারই বাধা দিতেন। মা বলতেন, আমার টাকায় আমার মা খাচ্ছে, তোমার সমস্যা কি?’

নাঈমা আরও বলেন, ‘মা একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন, তাই ভোরেই বাসা থেকে চলে যান, আসেন সন্ধ্যায়। বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, তাই বাসাতেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। ঘটনার আগে ঘরের দরজাতে তালা দেওয়াকে কেন্দ্র করে আমার নানির সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় বাবার। তখন আমার বাবা নানিকে গায়ে হাত তুলেন। মাকে জানালে অফিস থেকে এসে তিনি বিষয়টি মীমাংসা করবেন বলে নানিকে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু আমি আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে বিকালে ঘরে গিয়ে দেখি, আমার নানিকে হত্যা করা হয়েছে এবং আমার বাবা মোবাইল বন্ধ করে পালিয়েছে।

ঘটনার একদিন পর নিহতের ছেলে মো.জুয়েল বাদি হয়ে বন্দর থানায় মামলা করেন।

রাতভর চলে চোর-পুলিশ খেলা

ঘটনার দিন (রোববার) সন্ধ্যার পর থেকেই আসামিকে খুঁজতে থাকে বন্দর থানা পুলিশ। তবে পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও অপরাধ জগতে ভালোয় জ্ঞান রয়েছে তার। এর আগেও নগরীর বায়েজিদ থানাতে ইয়াবার মামলা হয় আজিমের বিরুদ্ধে। শাশুড়িকে হত্যার পর গ্রেপ্তার এড়াতে তাৎক্ষণিক মোবাইল বন্ধ করে দেন তিনি। পুলিশের অভিযানের খবরে ঘনঘন স্থান পাল্টাতে থাকেন তিনি।

এই বিষয়ে বন্দর থানার অপারেশন অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আসামির মোবাইল বন্ধ থাকায় আমরা তাকে ট্রেস করতে পারছিলাম না। তাই আমরা ওসি স্যারের নির্দেশে তার কল হিস্ট্রি থেকে কাছের মানুষদের থেকে ধারণা নিতে থাকি। ধারণা অনুযায়ী রাতভর নগরীর একাধিক জায়গায় অভিযানে যাই, এমনকি পাশের হাটহাজারী উপজেলাতেও আমরা যাই।’

অভিযানের সময় তথ্য পেতে বেশ বেগ পেতে হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি, তারা ভয়ে আমাদের তথ্য দিতে চাইছিলেন না। পরে অনেক কষ্টে তথ্যগুলো কালেক্ট করতে হয়। সারারাতের অভিযানের পর সকাল ১০টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা তাকে ডবলমুরিং এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করি।’

সাইফুল আরও বলেন, ‘টানা আট ঘণ্টারও বেশি সময় অভিযানের পর যখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তিনি অবলীলায় হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করে নেন। এমনকি হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যায় রূপ দেওয়ার বিষয়টিও জানান আমাদের।’

বিএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!