যৌতুকের জন্য রাঙ্গুনিয়ার গৃহবধূকে হাত-পা বেঁধে এমন নির্যাতন!

নির্যাতন স্পষ্ট, মামলা তবু দায়সারা

বিয়েটা হয়েছিল যৌতুক নিয়েই। তবু আরও যৌতুক চাই দুবাইপ্রবাসী ফোরকানের। কৃষক বাবার মেয়ে শানু সেই যৌতুক এনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। একপর্যায়ে স্বামী জড়িয়ে গেলেন পরকীয়ায়। ফলে বিয়ের পর থেকেই শুরু হল শানুর ওপর নির্যাতন। স্বামীর পাশাপাশি একসময় শ্বশুরবাড়ির অন্যরাও তাতে যোগ দিলেন।

১৮ মাস বয়সী সন্তানের মুখ চেয়ে সবই সহ্য করতে থাকলেন শানু আকতার। একপর্যায়ে স্বামী তাকে তালাক দিলেন। শানু তাতেও না গেলে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় মধ্যযুগীয় কায়দায় ঘটে নারকীয় ঘটনা। দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে শানুকে বেধড়ক মারধর করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

বিষফোঁড়া যৌতুকের নির্মম শিকার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক রাস্তার মাথা এলাকার গৃহবধূ শানু আকতারের (২৪) ঠিকানা এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নাম্বার ওয়ার্ড।

পাঁচ বছর আগে যৌতুক দিয়েই বিয়ে হয় পূর্ব সরফভাটার ৯ নং ওয়ার্ড এলাকার কৃষক আলী বক্সের মেয়ে শানু আকতারের। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিকল রাস্তার মাথার ৪নং ওয়ার্ডের বহদ্দার পাড়া এলাকার শাহ আহমদের দুবাই প্রবাসী ছেলে ফোরকান ছিলেন তার পাত্র।

অভিযোগে জানা যায়, ফোরকান বিয়ের কিছুদিন পরই অন্য মেয়ের সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় কারণে-অকারণে শানু আকতারের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাতে থাকে ফোরকানের পুরো পরিবারই। পাঁচ বছরের সংসারে শানু আকতারের রয়েছে ১৮ মাস বয়সী একটি মেয়ে। আগে কৃষক বাবার টানাটানির সংসারের দিকে চেয়ে সবই মুখ বুঁজে সহ্য করে যেতেন শানু আকতার। কিন্তু এরপরও বন্ধ হয়নি পাশবিক নির্যাতন। মেয়ের জন্মের পর ছোট্ট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করেও থেকে যেতে চেয়েছেন ফোরকানের সংসারে। এটাই বরং কাল হয়েছে শানুর।

মাসদুয়েক আগে শানু আকতারকে তার বাবার বাড়ি রেখে আসে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এর মাঝে ২০ দিন আগে শানু আকতারের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন ফোরকান। এর মধ্যেই শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলে শানু আকতারের ওপর শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সর্বশেষ শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় মধ্যযুগীয় কায়দায় ঘটে নারকীয় ঘটনা। দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে শানুকে বেধড়ক মারধর করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ইউসুফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুক্রবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে শানুর বাবা আমার হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে জানায় মেয়ের (শানুর) শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাত পা বেঁধে শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে। আমরা কয়েকজন মিলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি তখনও তার হাত-পা বেঁধে রেখেছে। শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন। আমরা স্থানীয় মানুষদের ডেকে এনে পুলিশকে জানাই। পরে শিলক উপ-থানার উপ পরিদর্শক মুজিব ও পুলিশ সদস্যদের সাহায্যে শানু আকতারকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। শানু আকতারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ইউসুফ আরও বলেন, ‘শানুকে এতটাই অমানবিক নির্যাতন করেছে যে উঠে দাঁড়ানোর মত অবস্থায় ছিল না। আমরা চার-পাঁচজন মিলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে অবস্থার অবনতি দেখে ডাক্তাররা তাকে চমেক হাসপাতালে পাঠায়।’

মোহাম্মদ হাসান মুরাদ নামের অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘শুক্রবার (১১ অক্টোবর) হঠাৎ সন্ধ্যার সময় মেয়ের মা আমাকে দেখে কান্নার স্বরে বললো, মেয়েটাকে বাঁচাও, তাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন হাত পাঁ বেধে নির্যাতন চালাচ্ছে। প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দিইনি।পরে ভাবলাম একটু দেখে আসি। গিয়ে দেখি খুব খারাপ অবস্থা। এরপর প্রথমে শিলক উপ-থানায় গিয়ে এসআই মুজিব সাহেবকে অভিযোগ করি। তিনি পরামর্শ দিলেন, আপনি তাদের নিয়ে স্পটে যান। আমরা আসতেছি। তখন আমরা যাওয়ার সময় স্থানীয় মেম্বারকে নিয়ে মেয়েটির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। মেয়েটিকে হাত পা বেঁধে চার-পাচঁজন মহিলা মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালাচ্ছে। ততক্ষণে পুলিশের লোকজনও হাজির হয়। পরে নির্যাতনের শিকার মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি।’

বর্তমানে শানু আকতারের শারীরিক অবস্থা মারাত্মক অবনতির পথে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ নাম্বার ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এদিকে ফোরকানের পরিবারের দাবি, শানু আকতার বিবাহ বিচ্ছেদের কথা শুনে আত্নহত্যার কথা বলায় তাকে হাত,পা বেঁধে রাখা হয়। কোনোরকম নির্যাতন চালানো হয়নি।

শানু আকতারের উপর শারীরিক নির্যাতনের বিষয় নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থানায় সাধারণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ওসি তদন্ত মাহবুব মিল্কি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওখানকার স্থানীয় চেয়ারম্যান আমাদের বললো মেয়েটাকে (শানু) তালাক দেওয়া হয়েছে। পরে এটা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়েছে। একপর্যায়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজন মারধর করেছে এবং মেয়েটার হাত-পাও বেঁধে ফেলছে। এরপর যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের থানায় এনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’

এদিকে বাদিপক্ষের আইনজীবী রাহিলা চৌধুরী রেখা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটাই হলো এদেশে যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র। মানুষ কতটা নির্মম হলে এই কাজ করতে পারে? এ ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং আসামিও এরেস্ট হয়েছে। কিন্তু মামলাটি যথাযথ হয়নি। যেখানে নির্যাতনের বিষয় সুস্পষ্ট, সেখানে সাধারণ মামলা দিয়ে আসামিদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আদালতে কথা বলবো।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!