ভোটের পর থেকে নৌকার রক্ত ঝরছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায়, চলছে লুটপাট

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক সাংসদ নদভীর অভিযোগ

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় নির্বাচনের পর থেকে নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলছে।সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে নৌকাকে ডুবানোর যাবতীয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হয় ঢাকায় বসা একজনের কলকাঠিতে। এখনও তার ইশারাতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের রক্ত ঝরছে। প্রধানমন্ত্রী বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যাদের নৌকা প্রতীক দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই এখন উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় যেতে পারে না। এ যেন জামায়াত-শিবিরের আমল সাতকানিয়া লোহাগাড়ায় ফিরে এলো।

ভোটের পর থেকে নৌকার রক্ত ঝরছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায়, চলছে লুটপাট 1

এমন সব অভিযোগ এনেছেন চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী। বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আবু রেজা নদভী বলেন, অত্যাচার-নির্যাতনের সব প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।

তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে আসনটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়াও একই আসনে তিনি দশম ও একাদশ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আবু রেজা নদভী বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পদে থেকে নৌকার বিরুদ্ধে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ, অকথ্য ভাষায় বিষোদগার করে নির্বাচন করা কতটা নৈতিক তার বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিলাম। নৌকার পক্ষে কাজ করায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর যে অত্যাচার শুরু হয়েছে তার সব প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ডকুমেন্টসসহ আমি পৌঁছে দেব।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন এমপি নির্বাচিত হই, ডা. মিনহাজ (স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা) আমার কাছে আসেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কথা বলে বিভিন্ন প্রকল্প ভাগিয়ে নিতে চান। পরে যখন জানতে পারি, এসব তিনি নিজে খেয়ে ফেলছেন। কেরানীহাট এলাকায় খাতুনগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুসলিম উদ্দিন ও ব্যবসায়ী আবুল হোসেনের জমি দখলের অপচেষ্টা চালান তিনি। দেওদিঘী এলাকায় মানুষের জমি দখল করতে যান। পরে তার বিষয়ে এলাকাবাসী প্রমাণসহ তথ্য হাজির করে। আমি এরপর থেকে ডা. মিনহাজকে আর কাছ ঘেঁষতে দিইনি। আশা করি, বর্তমান এমপি সাহেব ডা. মিনহাজের হিসেব-নিকেশ বোঝা শুরু করে দিয়েছেন।’

‘আই আইন্নি, তোঁয়ারা লুডিফুডি হাইয়ো’

আবু রেজা নদভী বলেন, ‘আমি নদভী এই দেশে ২৬ বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। হাজারও মসজিদ, ওজুখানা, মাদ্রাসা কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছি। ৩০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কার করেছি আরব বিশ্বসহ পৃথিবীর নানা দেশের সহায়তায়। বিভিন্ন দুর্যোগে এ পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষের হাতে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমি খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে হাজার হাজার গরু-ছাগল বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিয়েছি। ২০২২ সালে সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর ৬৫০০ পরিবারকে ঘর সংস্কারের কাজ করে দিয়েছি। আর সে কি-না বলে বেড়ায় আমি আমার এলাকার মানুষ থেকে টাকা নিয়েছি। নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে গিয়ে, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ওই কুচক্রী মহল নির্বাচনী শ্লোগান দিয়ে বলেছে, ‘বহুত দিন খাইও, আর ন হাইও। আমি তাদেরকে বলি, ‘আই আইন্নি তোঁয়ারা লুডিফুডি হাইয়ো, এবার হাইত ন পারি পল অইয়্যো (দেশে আমি এনেছি, তোমরা লুটেপুটে খেয়েছো, এবার খেতে না পেরে পাগল হয়েছো।’ এখন সে এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীদের নিয়ে চলাফেরা করে।’

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে সরকারি কোনো প্রকল্পের এক টাকার অনিয়ম আমার হাত দিয়ে হয়েছে, আমি রাজনীতি দেব। এই লোকগুলো বিমানের টিকিটের ভুয়া ছবি বানিয়ে ফেসবুকে প্রচার করেছে, আমি নাকি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছি। আসলে ভয় পেয়ে তারা এসব অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। আমি জনগণের খেদমত করছি ২৫ বছর ধরে, যা আমৃত্যু অব্যাহত থাকবে। রাজনীতি করতে হলে জনমুখী হতে হবে। জনগণের উন্নয়ন চিন্তা করতে হবে।’

ভোটে জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত

সাবেক সংসদ সদস্য নদভী বলেন, ‘বিগত সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ক্যাডারদের নৌকার বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছে ঈগল প্রতীকের প্রার্থীর লোকজন। তার বিনিময়ে তারা জামায়াতের নেতাকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেতানোর প্রতিজ্ঞা করেছে। এ কারণে বিগত দুই মাসে সাতকানিয়া লোহাগাড়ায় জামায়াতপন্থিদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল শুরু করেছে।’

একের পর এক হামলা, মামলা নিতে চায় না পুলিশ

নদভী অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর ওপর ন্যাক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়। এ ঘটনায় চরতী ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী, সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আমিন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রমজান, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মিনহাজ, ছাত্রলীগ নেতা শাহজাহান, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর ভগ্নিপতি গোলাম ফেরদৌস রুবেল, যুবলীগ নেতা কচির আহমদ কায়সারসহ অন্তত ২৫ নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নানকে হত্যার উদ্দেশ্যে কিডনিতে ছুরিকাঘাত করা হয়। চরতী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী, নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ও নৌকার এজেন্ট মোখতারের ওপর দফায় দফায় হামলা করা হয়। এসব ঘটনায় জড়িতদের নাম উল্লেখ করে এজাহার দায়ের করা হলেও স্থানীয় প্রশাসন মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরে মামলা নিলেও এজাহারে প্রধান প্রধান চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নাম বাদ দিতে হয় স্থানীয় প্রশাসনের চাপাচাপিতে। ফলে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের হামলা চালাতে শুরু করে।’

ভোটের পর থেকে চলছে নির্যাতন-অত্যাচার

তিনি তথ্যপ্রকাশ করেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের হোসেন নগর এলাকায় নৌকার পক্ষে কাজ করায় আরমানুল ইসলাম নামে এক যুবলীগ নেতাকে গুলি করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা। গুলির আঘাতে আরমানের চোখ থেঁতলে গেছে। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পরে তাকে ঢাকায় রেফার করা হয়। জয়নাল আবেদীন নামে এক ঈগল প্রতীকের সমর্থক সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন অস্ত্রধারী হামলা চালায় আরমানের বসতঘরে। মধ্যরাতে ফিল্মি স্টাইলে আরমানের ঘরে ঘিরে এলোপাতাড়ি গুলি নিক্ষেপ করে তারা। নির্বাচনের পর দিন ৮ জানুয়ারি এওচিয়া ইউনিয়নজুড়ে সারাদিন নৌকার সমর্থক আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মারধর ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর লালিত সন্ত্রাসীরা নৌকার পক্ষে কাজ করায় এওচিয়া এলাকার মঞ্জুর মেম্বার ও আওয়ামী লীগ কর্মী মনিরকে বেদম মারধর করা হয়। নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন করায় এওচিয়ার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বুলুকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বুলু ও তার ছেলেকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। হুমকির মুখে তারা সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ৮ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে সাতকানিয়া উপজেলা তাঁতী লীগ নেতা মাইনুদ্দিন চৌধুরীর ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এভাবে নৌকার কর্মী-সমর্থক হওয়ায় বিভিন্নজনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।’

ওয়াজের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীসহ নদভীকে গালাগাল

নদভী বলেন, ‘আমার সময়ে এলাকায় ওয়াজ হতো— হেদায়েতুল ওয়াজ। কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে। আমি এক শ্রেণির ওয়াজিয়ানদের সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আসতে দিইনি। এখন তারা আসছে। ওয়াজের শুরুতেই তারা আমাকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এবং বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করছে। এমন বক্তব্য দেয় যেন এটা ইসলামিক স্টেট হয়ে যাবে এবং এর শুরু হবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে।’

সাতকানিয়ায় এখন এমপি ১০-১২ জন!

সাবেক সংসদ সদস্য নদভী বলেন, ‘সাতকানিয়ায় এখন এমপি একজন না, ১০-১২ জন। সবচেয়ে শক্তিশালী এমপি ডা. মিনহাজুর রহমান। দুই দিন আগেও দেওদিঘী বাজারে ইফতার বিতরণ ও মাদক বিরোধী সমাবেশের কথা বলে লোকজন আনেন তিনি। পরে লোকজন এসে দেখে সবার হাতে আমার বিরুদ্ধে ব্যানার ফেস্টুন! পরে সেগুলো বিভিন্ন মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মিনহাজ ২০১৪ সালে আমার সঙ্গে ছিল। এখন আরেক জায়গায় গেছে। সে তো কোথাও স্থির হতে পারে না। বিজিসি ট্রাস্ট ও ইউএসটিসিতে ছিল। সেখানে থেকেও চলে গেছে। তার কাজ হলো কেউ এমপি হলে তার কাঁধে ভর করে সুযোগ-সুবিধা আদায় করা, অন্যের জমি-দখল করা।’

ফেসবুকে অপপ্রচার

নির্বাচনের পর অপপ্রচারে লিপ্ত একটি কুচক্রী মহল বিমান টিকেটের ভুয়া ছবি বানিয়ে ফেসবুকে প্রচার চালিয়েছে অভিযোগ করে নদভী বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল সামাজিকমাধ্যমে প্রচার করছে আমি নাকি কাতার চলে গেছি। তারা বিমানের টিকিটের ভুয়া ছবি বানিয়ে ফেসবুকে এসব প্রচার করে বেড়াচ্ছে। আমি কেন দেশ ছেড়ে যাব? এই সময়ে আমার বিদেশে ৫-৬টি কনফারেন্সের দাওয়াত ছিল। আমি কোথাও যাইনি। আমি জনগণের খেদমত করছি ৩০ বছর ধরে, যা আমৃত্যু অব্যাহত থাকবে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনোয়ন পাওয়ার পর দীর্ঘ ১০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাতকানিয়া লোহাগাড়াকে জামায়াত শিবিরের দুর্গ থেকে আওয়ামী লীগের দূর্গে পরিণত করেছিলাম।’

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নদভীকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মোতালেব। তিনি পেয়েছিলেন ৮৫ হাজার ৬২৮ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের নদভী পেয়েছিলেন ৩৯ হাজার ১৫২ ভোট। পরে এই নির্বাচনে জালভোটসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!