বিদেশি চ্যানেল বন্ধে ঘরে ঘরে হাহাকার, ক্ষোভে উত্তাল ফেসবুক

চট্টগ্রাম-ঢাকার ৭০ ভাগ দর্শকই দেখেন বিদেশি চ্যানেল

স্টার জলসা কিংবা জি বাংলা নয়, দেশি কোনো চ্যানেল তো নয়ই— আসিফ খানের পছন্দ শুধুই খেলার চ্যানেল। দিনে কিংবা গভীর রাতে স্প্যানিশ লীগ কিংবা ইউরোপের লীগ— কোনোটিই তার অদেখা থাকে না। এখন টিভি খুলে তিনি মাঝে মাঝে রিমোট টেপেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রিয় খেলার চ্যানেলগুলোতে এখন একটিই বার্তা— ‘সম্মানিত দর্শকবৃন্দ, সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমাদের ক্যাবল নেটওয়ার্কে আমরা ক্লিনফিডবিহীন বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার থেকে বিরত থাকবো। এর ফলে সৃষ্ট অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’

আসিফ খানই শুধু নয়, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের বাসিন্দা ইয়াসমিন জাহানও পুরোপুরি হতাশ তার প্রিয় চ্যানেলগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। তার ভাষায়, ‘বিনোদন বলতে এখন আমাদের সেভাবে কিছু নেই। হয়তো দু একটা নাটক দেখা হয়। এখন সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হল।’

হঠাৎ করে সব বিদেশি চ্যানেলই এক ঝটকায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে ঘরেই এখন হতাশা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে জানাচ্ছেন ক্ষোভও। তেমনই একজন দীপ্ত চক্রবর্তী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিদেশি চ্যানেলে অনেক ভালো কিছু দেখাতো। সেখানে খেলা, মুভি দেখা যেতো। এখন আর দেখা যাবে না। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে কী আছে? কিছু নাটক, এগুলো তো ইউটিউিবেই দেখা যায়। তাহলে শুধু শুধু কেন ডিস রাখবো আর বিল দিবো?’

বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে— তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এমন সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার ১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে বন্ধ করে দিয়েছে কেবল অপারেটররা। এর আগে বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, আইন অনুযায়ী দেশে বিদেশি চ্যানেলগুলোর বিজ্ঞাপনমুক্ত (ক্লিনফিড) সম্প্রচার বাস্তবায়নে ১ অক্টোবর থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

বিদেশি চ্যানেল বন্ধে ঘরে ঘরে হাহাকার, ক্ষোভে উত্তাল ফেসবুক 1

টিভি দর্শকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

তথ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবার (১ অক্টোবর) ঢাকার দুটি কেবল অপারেটরের কার্যালয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পরপরই খবরের চ্যানেল, খেলার চ্যানেল এবং ভারতীয় বিনোদন চ্যানেলগুলোসহ সব বিদেশি চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয় চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ সারা দেশের কেবল অপারেটররা।

বিদেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার এভাবে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন অনেক টিভি দর্শক। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ার বাসিন্দা সোহেল মাহমুদ বললেন, দেশি চ্যানেলগুলো এখনও বিদেশি জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর বিকল্প হয়ে ওঠেনি। এখন জোর করে কি দর্শকদের দেশি চ্যানেলের মানহীন অনুষ্ঠান গেলানো যাবে? আমরা তো ভাবছি, আর কিছুদিন পরও যদি এভাবে জোর খাটানো হয়, তাহলে ক্যাবল কানেকশন বন্ধ করে দেবো। ওটা রেখে লাভ কী?’

তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানাচ্ছেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ আবার এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, দেশি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের মান ভালো নয়। অন্যদিকে দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রচারের বিরোধিতা করে আসছিল। বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো)। সংগঠনটির সিনিয়র সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘অ্যাটকো সরকারি এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায়।’

বিজ্ঞাপনের অংক এতো সরল নয়

যে বিজ্ঞাপনের জন্য বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে গেছে, তা নিয়েও দ্বিমত প্রকাশ করছেন অনেকে। গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের মতে, বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত রাখলেই যে সেই বিজ্ঞাপনগুলো দেশি চ্যানেলে আসবে এবং রাতারাতি দেশি চ্যানেলগুলো লাভবান হয়ে উঠবে— সেই অংক এতো সরল নয়। তাদের মতে, বিদেশি চ্যানেলগুলো যে মানের অনুষ্ঠান তৈরি করে, সেই মানের অনুষ্ঠান বানানোর সক্ষমতা দেশি চ্যানেলগুলোর এখনও হয়নি। ফলে দেশি চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনদাতাদের আদৌ কতোটা আকর্ষণ করতে পারবে— সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ক্যাবল টিভির দর্শক প্রায় দেড় কোটি

ক্যাবল অপারেটর এসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ১০০টিরও বেশি চ্যানেল রয়েছে— যার দর্শক সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। অবশ্য ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরামের হিসাবে সারা দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেলের দর্শক প্রায় ছয় কোটি।

বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান কান্তার এমআরবি বাংলাদেশের এক দর্শক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দর্শকেরা যতক্ষণ টিভি দেখেন, তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ সময় তাদের চোখ থাকে বিদেশি চ্যানেলগুলোর ওপর। বাকি প্রায় ৩০ শতাংশ সময় তারা স্থানীয় চ্যানেলগুলোর সঙ্গে থাকেন। এই দর্শকদের গড়ে ১ শতাংশের কিছু বেশি বা কম সময় দিচ্ছেন বিটিভি দেখার জন্য।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরামের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৭৫ জন দর্শক বাংলাদেশি সব চ্যানেলের নামও জানেন না।

দেশি চ্যানেল কম দেখে দর্শকরা

বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দর্শকসংখ্যা দিনের পর দিন কমছেই। দেশি চ্যানেলের মানহীন অনুষ্ঠানের কারণে দর্শকদের বেশিরভাগই বিদেশি চ্যানেলমুখী হয়ে পড়েছেন। গত তিন দশকে ক্যাবল টিভির বিস্তার গ্রামের মানুষকেও অগণিত চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

এখন রিমোটের বোতাম টিপেই ইচ্ছামতো দেখা যাচ্ছে স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস, সনি, কালারস, জি টিভিসহ চ্যানেলের বাংলা-হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমা, গেম শো, রিয়েলিটি শো, নাচ-গান কৌতুকের অনুষ্ঠান। পরিবারে নারীদের মধ্যে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটকের জনপ্রিয়তা বেশি হলেও অনেক পুরুষই নিয়মিত এই নাটকগুলো দেখে থাকেন। অনেকে আবার অবসরের মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছেন ইউটিউব-ফেসবুক-টিকটকে। সবমিলিয়ে দেশি চ্যানেলগুলো থেকে প্রায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শকরা।

বিদেশি চ্যানেল না থাকলে গ্রাহকও থাকবে না

এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্যাবল অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) নেতারা আশঙ্কা করছেন, শুধু বাংলাদেশী ৩৪টি টিভি চ্যানেল দিয়ে কেবল অপারেটর সেবা চালু রাখলে গ্রাহক ধরে রাখা সম্ভব হবে না। গ্রাহকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থে ইউটিউব-ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলে যাবেন। এতে দ্রুত গ্রাহক কমে যাবে।

২০০৬ সালের ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন সংশোধনের দাবি জানিয়ে শনিবার (২ অক্টোবর) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কোয়াব নেতারা বলেন, এখন ইউটিউবের রমরমা অবস্থা। যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে বন্ধ হয়েছে, সেসব চ্যানেল তাদের প্রতিটি সিরিয়াল ইউটিউবে আপলোড করে দিচ্ছে। সেখানে কিন্তু বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। এই টাকাটা কিন্তু চলে যাচ্ছে ইউটিউব কোম্পানির কাছে। দেশের বাইরে থেকে অনেকগুলো অ্যাপস চলছে। হইচই, নেটফ্লিক্স, আমাজন, হট স্টার, জি-ফাইভ- এরা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে গ্রাহক নিচ্ছে। কোনো বৈধ উপায়ে তারা গ্রাহক নিচ্ছে না। এরা কিন্তু গ্রাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!