বিকেলে খালি হাতে ধরে রাতে ‘অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারে’র গল্প, হেফাজতে নির্যাতনের নালিশ

অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল আগে

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক যুবককে খেলার মাঠ থেকে বিকেলে ধরার পর রাতে দেখানো হয়েছে ‘অস্ত্রসহ’ গ্রেপ্তার। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা এক অডিওতে শোনা যায়, অন্তত দুমাস আগে সাতকানিয়া থানার এক পুলিশের সঙ্গে সোর্সের কথোপকথন হচ্ছিল ওই যুবককে ধরে অস্ত্রসহ চালান দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে। এদিকে গ্রেপ্তারের পর থানা হেফাজতে তুর্কির ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে তার স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া যুবকের নাম তানভীরুল ইসলাম ওরফে তুর্কি। ২৪ বছর বয়সী তুর্কি উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের এলাকার মাইজ পাড়ার মোবারক হোসেন ড্রাইভারের ছেলে। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। স্বজনরা বলছেন, তুর্কি স্থানীয় রাজনৈতিক রোষানলের শিকার। গত সংসদ নির্বাচনের পর তাকে বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। তবে পুলিশ বলছে, তুর্কি একাধিক মামলার আসামি।

খেলার মাঠে খালি হাতে গ্রেপ্তার

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, তুর্কি নামের ওই যুবককে সাতকানিয়ার ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়ার স্থানীয় একটি খেলার মাঠ থেকে ক্রিকেট খেলার সময় শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে সাতকানিয়া থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ওই সময়কার একটি ভিডিও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। সেখানে অন্তত শতাধিক মানুষের জটলাও ছিল।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করে বলেছেন, গ্রেপ্তারের সময় তুর্কির কাছ থেকে কোনো অস্ত্র বা অন্য কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি ওই সময় ক্রিকেট খেলছিলেন।

গ্রেপ্তার হওয়া তুর্কির বড় ভাই কফিল উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থানীয় খেলার মাঠ থেকে সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি টিম হঠাৎ করে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সেই সময় কয়েকশত মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা প্রত্যেকে দেখেছে, খালি হাতে তুর্কিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই সময় অস্ত্র-গুলি তো দূরের কথা, তার হাতে বা অন্যখানে কিছুই ছিল না। অথচ রাতে বিভিন্ন মাধ্যমে তুর্কিকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’

অস্ত্র এলো কোথা থেকে?

সাতকানিয়া থানার পুলিশ বলছে, ‘গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধায় ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি তানভীরুল ইসলাম ওরফে তুর্কিকে উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ফজুর পুকুর পাড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার  করা হয়। এ সময় তার পরিহিত প্যান্টের কোমর থেকে ১টি দেশীয় তৈরি কালো রংয়ের একনলা বন্দুক ও ৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।’

খেলার মাঠ থেকে তুর্কি গ্রেপ্তার হলেও সাতকানিয়া থানার পুলিশ দাবি করছে, ‘শুক্রবার বিকেলে ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়া ফুজার পুকুরের উত্তর পাশে একটি খোলা মাঠে তুর্কিসহ তার সহযোগীরা অবৈধ অস্ত্র বিক্রির জন্য অপেক্ষায় করছিল। এ খবর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে থানা পুলিশ জানতে পেয়ে ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করলে অস্ত্র ব্যাবসায়ীরা পুলিশের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পালানোর চেষ্টাকালে তানভীরুল ইসলাম তুর্কিকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাকে পুলিশ তল্লাশি করলে তার পরিহিত প্যান্টের কোমর থেকে একটি দেশীয় তৈরি কালো রঙের একনলা বন্দুক ও ৪ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সাতকানিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী বলেন, ‘আলমগীর পাড়া বিলে তুর্কির কাছ থেকে একটি  অস্ত্র ও চার রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করেছি আমরা। সেখানে যারা উপস্থিত ছিল, ওরা সাক্ষীও দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনসহ সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা তুর্কিকে খালি হাতে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী বলেন, ‘সে একটা মহা সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে কে সাক্ষী দেবে?’

থানা হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ

এদিকে সাতকানিয়া থানা পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে গ্রেপ্তার হওয়া তুর্কির বড় ভাই কফিল উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার ভাইকে থানায় খুব মারধর করেছে। আমার বোনসহ পরিবারের লোক তাকে দেখতে গিয়েছিল। তুর্কিকে থানায় ঢোকানোর সময় সুস্থই ছিল সে। কিন্তু পরে যখন থানা থেকে বের করা হয়, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায় সবাই। তুর্কির চেহারা ফুলে গেছে। প্রচণ্ড মারধরে সে হাঁটতেও পারছিল না।’

তুর্কির বড় ভাই অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার ভাই নিরীহ ছেলে। সে ছাত্রলীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রোষানলের শিকার। এখন আমার পরিবারের সদস্যদেরকে হুমকি ধমকি দিচ্ছে তারা।’

সাতকানিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী অবশ্য থানায় নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘স্বজনরা তো তুর্কির পক্ষেই কথা বলবে। উল্টো সে একাই আমার পাঁচজন পুলিশকে মেরে আহত করেছে।’

অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল আগে!

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা এক অডিওতে শোনা যায়, গ্রেপ্তারের আগে সাতকানিয়া থানার অধীন ঢেমশা বিটের এসআই রেজাউল চৌধুরীর সঙ্গে তার সোর্সের কথোপকথন হচ্ছিল তানভীরুল ইসলাম ওরফে তুর্কিসহ আরও কয়েকজন যুবককে ধরে অস্ত্রসহ চালান দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে। গত সংসদ নির্বাচনের পরপরই এই কথোপকথন হয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্র জানায়।

ওই কথোপকথনে এসআই রেজাউল পশ্চিম ঢেমশা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর উল্লেখ করে তাদের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য সোর্সকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এ সময় তুর্কি ছাড়াও আরও যাদের ‘খোঁজ’ চাইতে শোনা যায় ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে, তাদের মধ্যে রয়েছেন— লিটন, রিয়াদ, রুম্মন, সুমন, শহীদ, রিয়াদের ‘ঘাড়ত্যাড়া’ ড্রাইভারসহ আরও কয়েকজন। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ‘আমিনুল ইসলামের লোক’ হওয়ায় রুমনের বিষয়টা বাদ দিতে বলেন ওই এসআই।

কথোপকথনের একপর্যায়ে এসআই রেজাউলকে বলতে শোনা যায়, ‘মনে করেন যে, আমরা অস্ত্রসহ দিই দিয়ে দেবো।’ সোর্সকে ওই সময় বলতে শোনা যায়, ‘এখন অস্ত্র না দিয়া এমনে যে মামলা আছে, সেই মামলায় দিয়া দিলে কী হইছে?’ জবাবে ওই পুলিশ বলেন, ‘মামলায় দিয়ে দিব আর কি!’

সাতকানিয়া থানার এসআই রেজাউল অবশ্য এমন কথোপকথনের অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একমাস ধরে আমি অসুস্থ। হাসপাতালে আছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!