‘প্রতারণা’, চট্টগ্রামে শ্বাসকষ্টে কবিরাজি চিকিৎসার নামে টাকা হাতাচ্ছে টাউটরা

ড্রেনের উপর দোতালার ছোট্ট খুপড়ি ঘর। ওই ঘরে চলছে শ্বাসকষ্ট রোগীর চিকিৎসা। এখানে যে দুই চিকিৎসক আপন দুই ভাই। কিন্তু তাদের কোনো চিকিৎসক হিসেবে সনদ নেই। তাদের বাবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই রোগের চিকিৎসা স্বপ্নে দেখেছিলেন। বাবার স্বপ্নে দেখা চিকিৎসার দোহাই দিয়ে দুই সন্তান বনে গেছেন চিকিৎসক। শত শত রোগীকে তারা শ্বাসকষ্ট রোগের চিকিৎসার নামে করছেন প্রতারণা।

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রবাদের ডেবার দক্ষিণ পাড়ে রেডিও অফিসের পিছনে ‘আল্লাহর দান অলির দোয়া’ চিকিৎসালয়ের গল্প এটি।

শুধু এই প্রতিষ্ঠানই নয়, নগরীতেও আল্লার দান অলির দোয়া, কলকাতা হারবাল সেন্টার, ইউনানী হারবাল, মায়ের দোয়া, মাদ্রাজ হারবাল, ইন্ডিয়ান হারবাল ইত্যাদি নামে অনেক কথিত ভেষজ চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছে। আর এসব বিশাল সাইনবোর্ড আর মনোরম কার্যালয়ে বসে ভুয়া কবিরাজরা বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে করছে প্রতারণা। জড়ি, বুটি, সালসা, গরুর পিত্তথলি, মাদুলী, তাবিজ দিয়ে হাঁপানি রোগীকে সুস্থ করার গ্যারান্টিও দিচ্ছে কেউ কেউ।

এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই ইউনানী বোর্ডের কোনো সনদ নেই। এখানকার ডাক্তার ও কবিরাজদের অনেকের সরকার স্বীকৃত কোনো ইউনানী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র নেই। এদের অনেকে বিভিন্ন কবিরাজের সহকারী হিসেবে আগে কাজ করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান রোগী পেতে দিচ্ছেন চটকদার বিজ্ঞাপন।

জানা গেছে, রোগীর কাছ থেকে এসব কথিত কবিরাজি চিকিৎসক পরামর্শ ফি বাবদ আদায় করছেন ৩০০ টাকা। আবার রোগের লক্ষণ অনুযায়ী কথিত ওষুধের জন্য নিচ্ছেন চড়া দাম।

নগরীর আগ্রাবাদস্থ মিস্ত্রিপাড়া, দেওয়ানহাট, চেীমুহনী, হাজিপাড়াসহ বৃহত্তর আগ্রাবাদজুড়ে শীত আসার সাথে সাথেই হাপানি বা অ্যাজমা উপশমের এসব কথিত চিকিৎসকের পোস্টার, লিফলেটের দেখা মিলেছে।

একটি লিফলেটে উল্লেখ আছে, ‘চট্টগ্রামের বিখ্যাত ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্বর্পর্ণ মরহুম হাকীম হাফেজ মো. মোফাজ্জেল হোসেনের আবিস্কৃত হাঁপানি উপশম আল্লার দান অলির দোয়া।’

আরেকটি লিফলেটে লিখা আছে, ‘শ্বাস-কাঁশ ও হাঁপানি রোগের শতকরা শতভাগ গ্যারান্টিতে ঔষুধ দেয়া হয়।’

নগরীর আগ্রাবাদের ডেবার দক্ষিণ পাড় রেডিও অফিসের পিছনে সোবহান বিল্ডিংয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন হাকিম হাফেজ মোধ মোফাজ্জহল হোসেন। ডেবার পাড় রেডিও অফিসের পিছনে আল্লাহর দান অলির দোয়া চিকিৎসালয়ে গিয়ে দেখা গেলো, ড্রেনের উপর দোতালার ছোট্ট খুপড়ি একটি ঘরে বসেন চিকিৎসক। লিফলেটে চিকিৎসকের নাম মো. মোফাজ্জল হোসেন থাকলেও রোগী দেখেন হাফেজ রেজাউল করিম।

এর কারন জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, ‘তার বাবা বছর দশেক আগে মারা গেছেন। তার মেঝ ভাই আবদুল্লাহ সপ্তাহে দুইদিন রোগী দেখেন। আর বাকি দিনগুলোতে রোগী দেখেন তিনি নিজেই। রেজাউল করিম চট্টগ্রাম ইউনানী মেডিকেলে অধ্যয়নরত রয়েছেন।’

চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যাপারে তিনি জানান, ‘তার বাবা স্বপ্নে হাঁপানি রোগের ওষুধ তৈরীর সূত্র জেনেছিলেন। তারপর সেই নিয়মাবলী তাদের শিখিয়ে গেছেন। সেই স্বপ্নে পাওয়া ওষুধেই চলে তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম। শ্বাসকষ্ট রোগীদের রোগের কথা শুনে তিনি পাউডারের কাশির লিকুইড কফরিল ও হাঁপানি উপশম নামে পাউডার জাতীয় ঔষুধ দেন। দুই ওষুধ মিলে দাম পড়ে ৩২০ টাকা। ঔষধগুলো তারা নিজস্ব উপায়ে তৈরী করে থাকেন।’

কিন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এসব হার্বাল ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগী জটিল আকার ধারন করে। পরবর্তীতে আ্যাজমা শ্বাসকষ্ট চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলছেন, হাঁপানি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। শ্বাসকষ্টের কারণ তিনটি। প্রথমত শ্বাসনালি সংকুচিত হওয়া, দ্বিতীয় মিউকাস জাতীয় আঠালো রস নির্গত হওয়া এবং তৃতীয়ত প্রদাহের ফলে শ্বাসনালির মিউকাস আবরণী ফুলে যাওয়া। প্রদাহবিরোধী ওষুধ সরাসরি শ্বাসনালির অভ্যন্তরে ফুলা কমাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে মিউকাস জাতীয় রস তৈরি কমে যাবে এবং শ্বাসনালি প্রসারক ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াবে। এই প্রদাহবিরোধী ওষুধগুলো শ্বাসনালির সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে হাঁপানির প্রকোপ কমতে থাকে।

চিকিৎসকদের কেউ কেউ আতংকিত হয়েই বলছেন, শীত আসতেই শুরু হয়েছে হাঁপানী বা অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট। আর করোনাকালে শ্বাসকষ্ট রোগীদের থাকতে হচ্ছে আরও সতর্কতায়। এ রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন ও জীবনযাপন করা জরুরি। এসব রোগীদের কেউ কেউ ঠকছে এখন স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ সেবন করে। কথিত কবিরাজদের হাতে পড়ে তারা হচ্ছেন প্রতারিত। এসব ওষুধ খেয়ে রোগীদের ফুসফুসও নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়েও রেহাই মিলছে না তাদের।

এ বিষয়ে শিউলি আকতার নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার অ্যাজমা আছে। একদিন শাশুড়ী তাকে স্বপ্নে পাওয়া হাঁপানীর ওষুধ এনে খাওয়ায়। এরপর থেকে আমার গায়ে বিচির মত উঠতে শুরু করে। জ্বর থাকে সবসময় শরীরে। অ্যাজমাতো গেলই না, স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ উল্টো ক্ষতি করেছে আমার। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখালে ডাক্তার আমাকে ইনহেলার দেন। ‘

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট আব্দুর রব বলেন, ‘করোনা রোগীদের মধ্যে যাদের অবস্থা খারাপ হয়েছে তাদের আগে থেকেই অনেকের অ্যাজমা রোগ হয়েছে। এমনও রোগীকে পেয়েছি তার অ্যাজমা থাকলেও তার সঠিক চিকিৎসা আগে নেয়নি। অনেককে বাঁচানো যায়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেসব রোগী হাতুড়ে কিংবা স্বপ্নে পাওয়া ডাক্তারের কাছে গিয়ে শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করে, তাদেরই অবস্থা খারাপ হয় পরবর্তী পর্যায়ে। হাপানী বা অ্যাজমা যাই বলি না কেন, তার জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র ও নিয়ম মেনে ওষুধ সেবন।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!