তাপসের ‘খুনিরা’ আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে

ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার। ঘটনার এক বছর পাঁচ মাসের মাথায় এ মামলার চার্জশিট জমা দেয় আদালতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। চার্জশিট জমা হওয়ার সাড়ে বছর পার হলেও এ মামলার বিচার শেষ হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামীরা ঘুড়ে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে। দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে তারা চালাচ্ছে রাজনৈতিক কার্যক্রম। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ রাজনৈতিক গ্রুপের ছত্রছায়ায় থাকতে দেখা গেছে এই মামলার আসামীদের।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, তাপস সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সিএফসি গ্রুপের দাবি ছিল, এই গ্রুপেরই সদস্য ছিলেন তিনি। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিএক্স গ্রুপের সঙ্গে সিএফসি গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এ সময় শাহ আমানত হলে দাঁড়িয়ে থাকা তাপস সরকারকে ভিএক্স গ্রুপ নেতাকর্মীরা গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠে।

২০১৪ সালে ভিএক্স গ্রুপ এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের প্রক্টরিয়ালবডির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজনীতি করতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সিএফসি গ্রুপ ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতো চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে।

প্রশাসন ভিএক্স গ্রুপকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলে প্রক্টরিয়াল বডির তিন আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, লিটন মিত্র ও হেলাল উদ্দিন আহমদ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রুপ হিসেবে সিএফসি গ্রুপকে সমর্থন দেয়। এই তিন শিক্ষকের কারণে উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের মধ্যেও চরম অস্থিরতা দেখা দেয়।

মূলত ওই সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ কোন গ্রুপ থেকে হবে- এই দ্বন্দ্ব থেকেই
প্রশাসনপন্থি ভিএক্স গ্রুপ ও সিএফসি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয় বেশ কয়েকবার। একপর্যায়ে ভিএক্স গ্রুপের হাতে বিতাড়িত হয় সিএফসি গ্রুপ। বিতাড়িত হওয়ার পর তারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ করতে হবে। এ সময় প্রয়াত চবি উপাচার্য ড. আবু ইউসুফের স্মরণ সভায় নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়। ওই অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে সেদিন চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির হায়দার বাবুলকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে লাঞ্চিত করে। ওই সময় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত সিএফসি গ্রুপ এ ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনে নামে। টানা সাতদিন বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধ করে রাখে তারা।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হস্তক্ষেপ করেন হয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে। নগরীর চশমা হিলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় দফায় দফায় বৈঠক হয় নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফের সাথে। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর শক্ত অবস্থানের কারণে সিএফসি গ্রুপকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এসময় ভিএক্স গ্রুপের অনেকেই সিএফসিতে যোগদান করে। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আগ্রহেই ছাত্রলী-শিবিরের সংঘর্ষের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া শাহ আমানত হলে সিএফসি গ্রুপকে তুলে দেওয়া হয়। ভিএক্স গ্রুপের অবস্থান ছিল তখন শাহ জালাল হলে।

আবার সিএফসি গ্রুপের ক্যাম্পাসে প্রবেশকে মেনে নিতে পারেনি ভিএক্স গ্রুপের সদস্যরা। এ সময় ক্যাম্পাসে দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে।

এর জের ধরে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী চত্বরে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে ভিএক্স গ্রুপের সদস্যরা সিএফসি গ্রুপের কয়েকজন মারধর মরে। এরপর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল ও শাহ আমানত হলে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার।

এ ঘটনায় ওই রাতেই পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে আরও ৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে অস্ত্র আইনে মামলা করে হাটহাজারী থানা-পুলিশ। পরদিন রাতে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা করেন তাপসের সহপাঠী হাফিজুল ইসলাম। এই মামলায় ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। এতে ছাত্রলীগের সাবেক উপসংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান ওরফে আশাকে ১ নম্বর আসামি করা হয়।

অন্যদিকে পুলিশের করা মামলায় আশরাফুজ্জামানকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। এ হত্যার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৬ সালের ২ মে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৯ নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আশরাফুজ্জামানের ব্যবহার করা পিস্তলের গুলিতেই খুন হন তাপস। এরপর ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আশরাফুজ্জামান। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তিনি অস্থায়ী জামিন পান। এ ছাড়া এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ১৫ জন গ্রেপ্তার হন। আশরাফুজ্জামানসহ এই ১৫ জন জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

ছাত্রলীগকর্মী তাপস সরকারের ছোট ভাই শ্রাবণ সরকার এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বর্তমানে অনেক মামলারই বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে। আমার মা খুব অসুস্থ। ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে ৬ বছর ধরে প্রায়ই প্রতিদিনই তিনি কাঁদেন। এখন তার একটাই চাওয়া তিনি যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে পারেন। আমাদের বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করলে আমরা ভাই হত্যার বিচারটা পাবো।’

এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেন, ‘তাপস হত্যা মামলার বিচারকাজ কেন থেমে আছে আমার জানা নেই। যারা তাপসকে গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই। যখন দেখি তাপসের খুনিরা ক্যাম্পাসে দাপটের সাথে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় তখন ছাত্র সমাজের বুকে রক্তক্ষরণ হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু বলেন, ‘আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু তদন্তের ভিত্তিতে তাপস হত্যার বিচার হোক। প্রকৃত আসামীদের সাজা হোক। আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’

তাপস স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৪ সালে তাপস হত্যার বিচার হলে খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং আইনের আওতায় আনা হলে ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক উপ-ক্রীড়া সম্পাদক সাহিনের হাতের আঙ্গুল হারাতে হতো না। ২০১৯ সালে সাবেক সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন সুমন এবং ছাত্রলীগ নেতা রাফির উপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে তাপস হত্যা মামলার আসামীরা ক্যাম্পাসে একই অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। তাদের রক্ত পিপাসু মন আরো রক্ত চায়, আরো প্রাণ চায়। তাই অনতিবিলম্বে তাদের গ্রেফতারপূর্বক বিচারের রায় চাই৷’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!