পিয়াসার ফ্ল্যাটজুড়ে গোপন ক্যামেরা, মোবাইলে বাঘা বাঘা শিল্পপতির নম্বর

জিজ্ঞাসাবাদে মুখ খুলছেন ‘লম্বা হাতের’ পিয়াসা

রাজধানীর বারিধারায় মাসিক আড়াই লাখ টাকা ভাড়ার যে ফ্লাটে থাকেন মডেল পিয়াসা, সেই ফ্ল্যাটের ভেতরে বহু গোপন সিসিটিভি ক্যামেরার খোঁজ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এসব ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজগুলো দিয়েই পরবর্তীতে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করতেন পিয়াসা। পিয়াসার ব্যবহৃত মোবাইলে মিলেছে গুলশান-বনানী ও বারিধারা এলাকার অনেক বাঘা বাঘা শিল্পপতির মোবাইল নম্বর— যারা পিয়াসার বাড়িতে আয়োজিত পার্টিতে নিয়মিত যেতেন।

রাজধানীর বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনের ৯ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাসাটিই পিয়াসার ফ্ল্যাট। আড়াই লাখ টাকা মাসিক ভাড়ার ওই ফ্ল্যাটটির আয়তন চার হাজার বর্গফুট।

ঢাকার অভিজাত মহলে পরিচিত মুখ চট্টগ্রামের মেয়ে ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসাকে বারিধারার ওই বাসা থেকে রোববার (১ আগস্ট) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ধরার পর পুলিশ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ তুলেছে, পিয়াসা তার বাসায় ডেকে উচ্চবিত্তদের ব্ল্যাকমেইল করতেন। অভিযানে তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ, ইয়াবা জব্দ করার কথাও জানায় পুলিশ। পিয়াসার নামে গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করার পর সোমবার (২ আগস্ট) তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

৩২ বছর বয়সী পিয়াসার হাত অনেক লম্বা, তাকে সমীহ করে চলেন অনেক বাঘা বাঘা শিল্পপতিও— এমন কথা ঢাকার অভিজাত মহলে সবাই জানেন। সেই পিয়াসাই হঠাৎ করে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর বিস্মিত অনেকেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই পিয়াসা টার্গেট ছিল ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত পার্টিতে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তাদের ছেলেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন তিনি। এরপর নিজ বাসাতেই করেন পার্টির আয়োজন। মূলত এই সময়েই ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজটি হয়। পার্টিতে মদ্যপান কিংবা অন্য মাদকসেবনে সবাই যখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে যান, তখন অন্তরঙ্গ বিভিন্ন মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করে রাখা হয়।

পরে সেই ভিডিওগুলো নিয়ে চলতে থাকে ব্ল্যাকমেইলিং। ধনাঢ্য ব্যক্তি বা তাদের ছেলেদের এসব ভিডিও তাদের পরিবারের অন্যদের কাছে পাঠানো হবে— এমন ভীতি ছড়িয়ে আদায় করা হতো টাকা।

জিজ্ঞাসাবাদে পিয়াসা পুলিশকে জানান, সর্বশেষ শনিবার (৩১ জুলাই) রাতেও পিয়াসা তার বাসায় একটি পার্টির আয়োজন করা হয়। মদ ও ইয়াবা সেবনের ওই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন সাম্প্রতিককালে বিতর্কিত দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের ছেলেও।

চট্টগ্রামেই জন্ম ও মডেলিংয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল ঢাকার অভিজাত মহলে পরিচিত মুখ মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার। ১৯৮৯ সালের ১০ নভেম্বর এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম পিয়াসার। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পরিদর্শক বাবা মাহাবুব আলম ছিলেন প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তার মায়ের নাম রকি মাহাবুব।

চট্টগ্রাম নগরীর আসকারদিঘি এলাকায় ছিল পিয়াসার বাসা। ২০১৫ সালে ঢাকায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে সাফাত আহমেদের সঙ্গে পিয়াসার বিয়ের যে কাবিননামা হয়, সেখানে পিয়াসার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ ছিল— ৩ আর কে মিশন লেন, আসকরদিঘীর পশ্চিম পাশ, চট্টগ্রাম। এক টাকা দেনমোহরের ওই বিয়েতে কন্যাপক্ষে উকিল ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাজিরহাট এলাকার আব্দুল জলিলের পুত্র আব্দুল মোতালেব।

২০০৮ সালের দিকে পিয়াসাকে প্রথম অংশ নিতে দেখা যায় চট্টগ্রামে ঈদ উপলক্ষে দৈনিক সমকাল পত্রিকার একটি ফ্যাশন সংখ্যার ফটোসেশনে। এরপর তাকে দেখা গেছে স্থানীয় কয়েকটি ফ্যাশন শোতেও। তবে তার লক্ষ্য ছিল আরও বড়। পরের বছরেই পিয়াসা তার মা রকি মাহাবুবকে সঙ্গী করে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় যাওয়ার কিছুদিন পর পিয়াসার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে এশিয়ান টিভির সাবেক এমডি মিজানুর রহমানের সঙ্গে। এর সূত্র ধরে ধীরে ধীরে মিডিয়াপাড়ার পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন পিয়াসা। এ সময় তাকে টিভি উপস্থাপক হিসেবেও দেখা যায়। একসময় তিনি হয়ে ওঠেন এশিয়ান টেলিভিশনের পরিচালক এবং প্রিভিউ কমিটির প্রধান। এনটিভির রিয়েলিটি শো ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’র অন্যতম প্রতিযোগীও ছিলেন পিয়াসা।

পিয়াসা এ সময় নানা কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তোলেন ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছাড়াও ধনীর সন্তানদের সঙ্গে। তাদের সুনজরে থেকে বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন। গুলশান বারিধারার অভিজাত ফ্লাটে বসবাস তার। চড়েন কোটি টাকার বিএমডাব্লিউ গাড়িতে। সন্ধ্যা হলেই তাকে একদল তরুণী নিয়ে রাজধানীর অভিজাত সিসা বা মদের আড্ডায় দেখা যায়।

সর্বশেষ তাকে সোহানা গ্রুপ ও কক্সবাজারের বিলাসবহুল হোটেল হোয়াইট স্যান্ড রিসোর্টের পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা গেছে।

২০১৫ সালে দীর্ঘদিনের প্রেমিক আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে সাফাত আহমেদকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনায় আলোচনায় আসেন পিয়াসা। ২০১৭ সালে মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় তার নাম সামনে আসে। সর্বশেষ গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পর যে মামলা হয়েছিল তাতেও পিয়াসার নাম ছিল।

২০১৭ সালের মে মাসে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে নাম ছিল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার। প্রথমে মামলা করতে ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করেছিলেন পিয়াসা। কিন্তু সেই পিয়াসার বিরুদ্ধেই আবার মামলা তুলে নেওয়ার হুমকির অভিযোগে জিডি করেছিলেন ভুক্তভোগী। চার বছর পর আবারও আলোচনায় আসেন সেই পিয়াসা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!