নেতা পাল্টানোয় ঘাগু টিনুর দায় নিচ্ছেন না বিএসসি-নাছির-নওফেলও
চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীর দায়ভার নিতে চান না কেউই
সুযোগ বুঝে নেতা পাল্টানোই তার স্বভাব— কখনও এই নেতা, কখনও আবার ওই নেতা। যখন যার প্রভাব বেশি থাকে, তার ছায়াতলে ঢুকে যান তিনি কায়দা করে। চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারকেন্দ্রিক কথিত যুবলীগ নেতা নূর মোস্তফা টিনুর স্বভাবই এমন। তবে নেতা পাল্টানোয় হ্যাটট্রিক করেও শেষপর্যন্ত এই কিশোরগ্যাং লিডারের বর্তমান অবস্থায় তার দায় নিচ্ছেন না কোনো নেতাই।
সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া নূর মোস্তফা টিনু একসময় সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম বিএসসির ‘কাছের লোক’ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন। বিএসসি সবশেষ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ যাওয়ার পর টিনু একসময় চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের সঙ্গে ভেড়ার চেষ্টা করেন। সবশেষ তার টার্গেট হয়ে ওঠেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। ‘উপমন্ত্রীর অনুসারী’ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাতে থাকেন। কিন্তু এই তিন নেতার কেউই টিনুকে তাদের কর্মী বলতে নারাজ। তার দায় নিতে চান না কেউই।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতিতে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে মহিউদ্দিন চৌধুরীপুত্র নওফেলের অনুসারী অংশটি। এটা বুঝতে পেরেই নূর মোস্তফা টিনু নিজেকে মহিউদ্দিন গ্রুপ তথা নওফেল গ্রুপের একনিষ্ঠ কর্মী দাবি করে ব্যানার-ফেস্টুনে ভরিয়ে তুলেছেন নগরীর অলি-গলি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিনুর অনুসারীরাও মহিউদ্দিন ও নওফেলের ছবির সঙ্গে টিনুর ছবি লাগিয়ে শেয়ার দিচ্ছেন বাহারি সব ব্যানার। কিন্তু নওফেল সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি কোনো চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীর দায়ভার নেবেন না।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘কেউ যদি আমার নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে— তবে তার দায়ভার আমি তো নেবো না। প্রশাসনকে আমি সাফ জানিয়ে দিয়েছি কেউ যেন আমার ছবি ও নাম ব্যবহার করে পার পেয়ে না যায়।’
টিনু প্রসঙ্গে উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো তাকে আশ্রয় দিইনি, শেল্টারও দিইনি। আর দেবোও না। কারও জন্য আমি থানায় ফোন করে তদবিরও করিনি, বাঁচানোর চেষ্টাও করিনি। কেউ এরকম প্রমাণও দিতে পারবে না।’
রাজনৈতিক বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, চকবাজারকেন্দ্রিক কথিত যুবলীগ নেতা নূর মোস্তফা টিনু লাইমলাইটে ওঠে আসেন মূলত নুরুল ইসলাম বিএসসি মন্ত্রী থাকার সময়ে। এই সময়টাতেই টিনু মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ইচ্ছেমতো ফায়দা লুটেছেন। সূত্র বলছে, টিনুর প্রতিও বেশ স্নেহশীল ছিলেন বিএসসি আর সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার ছাড়াও টিনু হাতিয়েছেন বিপুল অর্থবিত্তও।
তবে স্নেহের সেই টিনু এখন সাবেক বৈদেশিক ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ‘চোখের বালি’। সূত্র বলছে, মন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর বিএসসির বাড়ির পথও মাড়াননি টিনু। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় নুরুল ইসলাম বিএসসি রাগের সুরেই বললেন, ‘টিনু কখনোই আমার কর্মী ছিল না। সে বললে তো আর হবে না। আমার কোনো কর্মী নেই। সে যেহেতু আমার কর্মী না, তাই আমি তার বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নই।’
রাজনৈতিক বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, মন্ত্রিসভা থেকে বিএসসি বাদ পড়ার পরপরই টিনু রাতারাতি পাল্টে ফেলেন তার রাজনৈতিক জার্সি। বদলে ফেলেন নেতা। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম সিটির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর চট্টগ্রামে তখন আ জ ম নাছিরের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য। আর সেই সুযোগে বিএসসির সঙ্গে আড়ি কেটে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন নাছির শিবিরে। নাছিরকে নিজের নেতা হিসেবে জাহির করে ব্যানার ফেস্টুনে ভরিয়ে তোলেন নগরী। তবে একেবারে প্রত্যাখ্যাত না হলেও নাছির শিবিরে সেভাবে সুবিধা করতে পারেননি টিনু।
টিনু সম্পর্কে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা একেক সময় একেকজনের নাম ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থানকে মজবুত রাখতে চায়। কিন্তু টিনু কখনও আমার কর্মী ছিল না। চকবাজারের মানুষ নিশ্চয়ই জানে, সে কার রাজনীতিতে ছিল এবং আছে।’
১৯৯৬ সালের দিকে ভিডিও গেমসে দোকানে কর্মচারী হিসেবে জীবন শুরু করা নূর মোস্তফা টিনুর অন্ধকার জগতের প্রভাবশালী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে তার অপর দুই ভাইয়ের। টিনু নিজেকে যুবলীগ নেতা পরিচয় দিলেও তার অপর দুই ভাই ভিন্ন দুটি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে বড় ভাই মোহাম্মদ সেলিম জামায়াতে ইসলামী চকবাজার ওয়ার্ডের আমির এবং ছোট ভাই নূর মোস্তফা শিপু চকবাজার ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি।
দেখা গেছে, এই তিন সহোদর তিনটি রাজনৈতিক আর্দশকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন সমানভাগে। দেশে যখন যে সরকারই আসুক না কেন তাদের কখনোই পোহাতে হয় না রাজনৈতিক ঝামেলা।
২০০৩ সালে অত্যাধুনিক একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে ধরা খেয়ে বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে ছিলেন টিনু। এর মধ্যে ছোট-বড় মাদক, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলা শেষে সর্বশেষ ২০১৯ সালে পুনরায় বিদেশি পিস্তল,একটি শর্টগান ও ৬৭ রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের হাতে আটক হন টিনু। পরে সেই মামলায় জামিনে বেরিয়ে এলেও গত ২০ জুন আবার জেলে ঢুকতে হয় টিনুকে।
সিপি