হৃদরোগ বিভাগেরই অসুখ চট্টগ্রাম মেডিকেলে— মেশিন নষ্ট দু বছর, রোগী যায় এপিকে

১ হাজার টাকার পরীক্ষা বাইরে করাতে হয় সাড়ে তিন হাজারে

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১২ নম্বর হৃদরোগ ওয়ার্ড নিজেই যেন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত। অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে স্পর্শকাতর এই বিভাগটি। গরিব রোগীদের জন্য এই হাসপাতালটি বড় আশ্রয় হলেও যথার্থ চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে অনেক রোগীকেই চোখের জল ফেলে চলে হয় বাড়িতে। গুরুত্বপূর্ণ এই হৃদরোগ ওয়ার্ডে রোগী অনুযায়ী জনবলও নেই। ইকো, ইটিটি, হল্টার মেশিন নষ্ট অন্তত বছরদুয়েক ধরে।

বলতে গেলে, হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিই প্রায় নষ্ট। ফলে বেশি দামে রোগীদের বাইরের বিশেষ একটি বাণিজ্যিক ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। সরকারিভাবে ইটিটি পরীক্ষার ফি ১ হাজার টাকা হলেও বাইরের বিশেষ ল্যাবে সেটা করাতে হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকায়। ৬০০ টাকার ইকো পরীক্ষা করাতে হয় ১২০০ টাকায়। এ ব্যয় বহন করা অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না।

চমেক হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগ চালু হয় ১৯৮৯ সালে। আগে বিভাগে শয্যা ছিল ৬০টি। রোগীর চাপের কারণে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ শয্যায়। তারপরও জায়গার সংকুলান হয় না। শয্যা ও মেঝেতে মিলে দিনে গড়ে ৩০০ রোগী থাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে।

জানা গেছে, হৃদরোগ বিভাগে জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেশিনগুলো নষ্ট থাকায় রোগীদের বেশি দামে বাইরের এপিক হেলথ কেয়ার ল্যাব থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। অনেক গরিব রোগী ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে চিকিৎসা না নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। কয়েকদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে এর সত্যতা।

জানা গেছে, ইটিটি হল ‘এক্সারসাইজ টলারেন্স টেস্ট’— যাতে বিশেষ ব্যায়ামের মাধ্যমে দেখা হয় হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে কোনো ব্লক আছে কিনা। যাদের বুকে ব্যথা হয়, পরিশ্রম করলে সমস্যা হয় অথবা যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ আছে কিংবা ধূমপায়ী রোগীদের ইটিটি করা হয়। হার্ট অ্যাটাকের পরও এই পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে। ইটিটি করতে রোগীকে একটি ট্রেডমিলে (ব্যায়ামের যন্ত্র) হাঁটতে হয় ৬ থেকে ৯ মিনিট। ওই সময়টাতে রোগীর ক্রমাগত ইসিজি করা হয়। এ সময় ইসিজির পরিবর্তন দেখে ইটিটি রিপোর্ট করা হয়। এই পরীক্ষার সময় ইসিজি ও ইকোকার্ডিওগ্রাম পরীক্ষার রিপোর্টও সঙ্গে রাখতে হয় সচরাচর।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় চমেক হাসপাতালে ইটিটি পরীক্ষার মেশিনগুলো নষ্ট পড়ে থাকায় সিসিইউতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের স্বল্প খরচের ইটিটি পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বাইরের ল্যাবে বেশি খরচে।

জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের ইকো রুমে দুটি ইকো মেশিন সচল ছিল। কিন্তু একটি নষ্ট হয়ে আছে প্রায় দুই বছর ধরে। এর মধ্যেও সচল ছিল একটি। ওই মেশিনটি যখন সচল ছিল, তখন ওয়ার্ডবয়রা প্রতি রোগীর কাছ থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নিয়ে বিনা রশিদে ইকো করার ব্যবস্থা করে দিতেন। এতে মেশিনের ওপর চাপ বেশি পড়ায় সেই মেশিনটিও নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট মেশিন কিছুদিন পর পর ঠিক করলেও পুনরায় তা আবার নষ্ট হয়ে পড়ে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনিয়র নার্স।

জানা যায়, একজন রোগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি হলে প্রথমেই তাকে ইসিজি ও ইকো করতে দেন চিকিৎসকরা। সরকারিভাবে ইসিজি পরীক্ষার ফি ৮০ টাকা। ইকো ফি ২০০ টাকা এবং কালার ইকো ফি ৬০০ টাকা। আর ইটিটি ফি ১ হাজার টাকা। বাইরের ল্যাবে ইসিজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, ইকো ১ হাজার ২০০ টাকা আর ইটিটি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ ব্যয় বহন করা অনেক দরিদ্র রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। আগে চমেক হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন রোগীর ইটিটি পরীক্ষা করা হতো।

চমেক হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ইটিটি মেশিন পুরোই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। রুমটিতে যে তালা লাগানো আছে, তাতে প্রায় জং ধরে গেছে। একই অবস্থা হল্টার মনিটরিং রুমেও। হল্টার মেশিন দিয়ে হৃদরোগীর হৃদস্পন্দন পর্যবেক্ষণ করা হয়। ওই হাসপাতালে টানা কয়েক দিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হৃদরোগের প্রতিটি রোগীর বেডে মাথার পাশে বেসরকারি ল্যাব এপিক হেলথ কেয়ার ল্যাবের ফাইল। সেই ফাইলে রয়েছে ইসিজি, এক্সরে, ইকো, ইটিটি রিপোর্ট।

এপিক হেলথ কেয়ার ল্যাবে রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কারণ হিসেবে জানা গেছে, বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. প্রবীর কুমার দাশসহ কয়েকজন চিকিৎসক এপিক হেলথ কেয়ার ল্যাবে চেম্বার করেন। তবে প্রবীর কুমার দাশ পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো ধরনের প্রভাব খাটানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে গত বছরের চিত্র থেকেও বর্তমান চিত্র খুবই শোচনীয়। হৃদযন্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিই প্রায় নষ্ট। মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের অপরিহার্য ঠিকানা করোনারি কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রও নষ্ট। বিভাগে একটি ক্যাথল্যাব থাকলেও অন্য আরেকটি বিভাগের সঙ্গে সেটি যৌথভাবে ব্যবহার করতে হয়। ফলে রোগীদের এনজিওগ্রাম ও এনজিওপ্লাস্ট করতে অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসপাতালের কার্ডিওলজি বা হৃদরোগ বিভাগে বর্তমানে ১০০ টি শয্যা রয়েছে। বহির্বিভাগে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই শতাধিক রোগী আসেন। এদের বেশিরভাগই দরিদ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ বিভাগে ইসিজি ছাড়া হৃদরোগীদের অন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। বহির্বিভাগের রোগীরা সব পরীক্ষা হাসপাতালের বাইরে থেকে করিয়ে আনেন। আবার প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে এসব পরীক্ষা ব্যয় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষে সেইসব পরীক্ষা করানো সম্ভব হয় না। ফলে রোগ নির্ণয় না হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বিনা চিকিৎসায় ফিরে যেতে হয়।

হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, হৃদরোগীদের ২৪ ঘণ্টার হার্টের ইসিজি রেকর্ড রাখতে হল্টার মেশিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু হাসপাতালের এ মেশিনটি প্রায় দুই বছর ধরে নষ্ট। চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে ইটিটি মেশিনও প্রায় দু’বছর ধরে নষ্ট। ইটিটি পরীক্ষায় হার্টের কোনো ঝুঁকি দেখা দিলে রোগীর এনজিওগ্রাম করতে হয়। অথচ হাসপাতালের দুটি ইকো কার্ডিওগ্রাফি মেশিনও বিকল। হার্টের প্রকৃত অবস্থা দেখার জন্য ইকো করতে হয়। একজন রোগীর হার্টে কোনো ছিদ্র আছে কিনা, বাল্ব ঠিক আছে কিনা, হার্টে পানি জমে কিনা, শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক আছে কিনা ইত্যাদি জানতে ইকোর কোনো বিকল্প নেই।

চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ২১ শয্যার সিসিইউ রয়েছে, যাতে মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের রাখা হয়। কিন্তু সিসিইউর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি প্রায় ছয় মাস ধরে নষ্ট। ফলে গরমে রোগীদের অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ক্যাথল্যাব মেশিন মাত্র একটি। সেটি নিউরো সার্জারি বিভাগও ব্যবহার করে। ফলে প্রতিদিন হৃদরোগীদের এনজিওগ্রাম এবং এনজিওপ্লাস্ট করা সম্ভব হয় না। এছাড়া হাসপাতালের একজন সহযোগী অধ্যাপকের পদ দুই বছর এবং দু’জন সহকারী অধ্যাপকের পদও এক বছর ধরে শূন্য পড়ে আছে।

চিকিৎসকেরা জানান, রোগী অনুযায়ী জনবল নেই এই বিভাগে। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিয়ে রোগীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি রয়েছে। চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে চিকিৎসক দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, একজন সহযোগী অধ্যাপক, তিনজন সহকারী অধ্যাপক, দুজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, একজন রেজিস্ট্রার ও তিনজন সহকারী রেজিস্ট্রার দিয়ে বর্তমানে এই বিভাগ চলছে। এই পদের বাইরে আরও একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং দুজন সহকারী অধ্যাপক সংযুক্তি এবং বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু স্থায়ী চিকিৎসা কর্মকর্তা নেই। এমডি করা শিক্ষার্থীদের দিয়ে এ বিভাগের বেশিরভাগ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ ওয়ার্ডে স্থায়ী অধ্যাপকের পদও সৃষ্টি করা যায়নি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ১২ নং সিসিইউ ওয়াডের বিভাগীয় প্রধান ডা. প্রবীর কুমার দাশ অল্প কিছুদিনের মধ্যে অবসরে চলে যাচ্ছেন। তাই তিনি তার বিদায়কালে কোনো নষ্ট যন্ত্রপাতির দায় নিতে রাজি নন। আর এ জন্য তিনি কোন চাহিদাপত্রও জমা দেননি হাসপাতালের পরিচালক বরাবরে।

ডা. প্রবীর কুমার দাশের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ মাসের (জুন) ৩০ তারিখে অবসরে চলে যাচ্ছি। আমি তো নষ্ট কোনো যন্ত্রপাতির চাহিদা দিতে পারি না। এটা দিতে পারেন পরিচালক। তবে মেশিনগুলো যে নষ্ট, সেটি আমিও জানি। ঠিক করা হলেও আবার নষ্ট হয়ে যায়। পরবরতীতে যিনি দায়িত্বে আসবেন বিষয়টি তিনি দেখবেন।’

বেসরকারি ল্যাব এপিক হেলথ কেয়ার ল্যাবে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘আমি সেখানে চেস্বার করি। এখানে তো আমার কোন শেয়ার নেই, স্বার্থও নেই। আর আমি তো চলেই যাচ্ছি। এসব নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!