দেয়াং পাহাড় কেটে কেটে বাণিজ্যে মেতেছে কেইপিজেড

কর্ণফুলী-আনোয়ারার প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষপ্রায়

পাহাড়কে বলা হয় প্রকৃতির পেরেক। ভূমিকম্প প্রতিরোধক বললেও ভুল হবে না। আর সেই পেরেকেই একের পর এক সাবাড় করে কারখানা তৈরি করছে কোরিয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) কর্তৃপক্ষ। কেইপিজেডের আওতাধীন এলাকাটি আনোয়ারা ও কর্ণফুলী দুই উপজেলার মাঝখানে অবস্থিত। এই দুই উপজেলার দুই হাজার ৪৯২ একর পাহাড়ি ভূমিতে কেইপিজেড গড়ে ওঠে।

দেয়াং পাহাড় কেটে কেটে বাণিজ্যে মেতেছে কেইপিজেড 1

তথ্য বলছে, পৃথিবীর সহায়ক বস্তু হিসেবে পাহাড় ও পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। আর সেই রহস্যময় সৃষ্টির গায়ে রাত-দিন এস্কেভেটর মেশিনের ভারি আঘাত। এতে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে আবাস। আর কোরিয়ান ইপিজেডের কারণেই বিলুপ্ত হচ্ছে দেয়াং পাহাড়ের সৌন্দর্য। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই দেয়াং পাহাড় মুছে যাবে মানচিত্রের পাতা থেকে।

সরেজমিনে দেখা যায়, খননযন্ত্র দিয়ে বড়উঠান এলাকা থেকে আনোয়ারা বৈরাগ পর্যন্ত উঁচু পাহাড় কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করা হচ্ছে। বিলুপ্তির পথে এখন দেয়াং। বাকি যে টিলা-পাহাড়গুলো রয়েছে সেগুলো কেটে মাটি একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা, ইমারত ও রাস্তা।

বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় পাহাড় ধসের কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— পাহাড়ের মাটি কেটে নেওয়া, অবাধে বৃক্ষনিধন, সড়ক নির্মাণের জন্য পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে দেওয়াসহ আরও নানা কারণ। তারা বলেছেন, প্রকৃতিকে বাঁচাতে হলে আগে পাহাড়গুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কারণ পাহাড়ের উর্বর মাটি খাদ্যেরও জোগান দেয়। পাহাড়-পর্বত প্রকৃতির আশীর্বাদ, যা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার ওপরেই বর্তায়।

কর্ণফুলী উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন,‘বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। কেইপিজেডের যে অংশে পাহাড় কাটা হচ্ছে তা সম্ভবত আনোয়ারার অংশে। তবুও খোঁজখবর নিয়ে বিধিসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পরিবেশের যাতে ক্ষতি না হয়, সেভাবে পাহাড়ের টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। যেসব শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমতি দিয়েছে, আমরা কোনোভাবেই ওই শর্ত লঙ্ঘন করিনি।’

কিন্তু চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, ‘কেইপিজেড কর্তৃপক্ষকে ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর এক চিঠিতে পাহাড় ড্রেসিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। পাহাড় কেটে বিলুপ্ত করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এমনকি পাহাড়-টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদফতরকে জানাতে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে তাঁরা পাহাড় কাটছে। এসব নির্দেশ অমান্য করায় হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্যও নির্দেশ দেন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, ‘কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ শিল্পায়নের নামে পাহাড় কেটে যাচ্ছে সমানে। দেয়াং পাহাড়গুলো যখন ছিল, তখন লোকালয়ে কখনো হাতি আসত না। এখন বন্যপ্রাণীগুলো তাদের বাসস্থান হারিয়ে লোকালয়ে আসছে। দেয়াং পাহাড় এখন নামে আছে, কাজে নেই।’

জানা যায়, গত বছরের ১ নভেম্বর হাইকোটের নির্দেশে আনোয়ারা উপজেলার প্রশাসন পাহাড় কাটা বন্ধ করে দেয়। যা নিশ্চিত করেছেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন। ২০১২ সালে প্রথম পাহাড় কাটার অভিযোগে কেইপিজেডের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তর।

২০১৫ সালে কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) অপসারণসহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছিল আনোয়ারা-কর্ণফুলী জনস্বার্থ সংরক্ষণ সংগ্রাম পরিষদ নামের একটি সংগঠন। সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনে তারা বলেছিলেন, কেইপিজেডে ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১ হাজার পরিবারকে এখনও পুনর্বাসন করা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের চাকরির নিশ্চয়তাও উপেক্ষা করেছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!