ডাক্তারকে ‘রিপোর্ট’ দেখাতেও ফি— এক গরু যেন দুবার জবাই

সময়ের যথেষ্ট দাম আছে— যুক্তি ডাক্তারের

রোগী দেখাতে ডাক্তারকে ফি দিতে হয় সেটা সবার জানা। রোগী দেখে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে যেসব ডায়গনোসিস পরীক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই রিপোর্ট দেখতেও ফি নেওয়া এতদিন সাধারণ নিয়মে ছিল না। সেটাই এখন রীতিমতো নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন চট্টগ্রামের কিছু ডাক্তার। এতে যেমন শুধু ডাক্তার দেখাতেই আর্থিক চাপের মুখে পড়ছে, আবার তারা অহেতুক হয়রানিতেও পড়ছে। ব্যয়বহুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবার রিপোর্ট দেখাতেই বাড়তি খরচ গোণা গরিব রোগীদের ওপর বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

চট্টগ্রামে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ফি করোনার প্রথম ঢেউ থেকেই ন্যূনতম ৮০০ টাকা থেকে লাফিয়ে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ টাকা হয়ে যায়। তখন থেকেই এই ফিসের সাথে যোগ হয় ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট’ দেখানো বাবদ আরেক দফা বাড়তি ফি। এ যেন এক গরু দুবার জবাই। রোগ সারাতে এসে ফিসের চাপে জান যায় রোগীর। চট্টগ্রাম নগরীর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বার ঘুরে যে চিত্র চোখে পড়েছে, তাতে রোগীদের হয়রানি ছাড়া কিছু নেই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেইন গেটের উল্টো দিকে এপিক হেলথ কেয়ারের চতুর্থ তলার ৪০৩ নম্বর চেম্বারে রোগী দেখেন ডা. এনএম সাইফ উদ্দিন নিজামী নয়ন। চট্টগ্রাম মেডিকেলের ইউরোলজি বিভাগের তিনি সহকারী অধ্যাপক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার পর তার ফি ৬০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তিতে লেখা রয়েছে নতুন রোগী দেখাতে ফি ৭০০ টাকা, পুরাতন রোগীর (এক মাসের মধ্যে) এই ফি ৪০০ টাকা। অন্যদিকে রিপোর্ট দেখানোর ফি হিসেবে তিনি নেন ২০০ টাকা।

এ বিষয়ে ডা. এনএম সাইফ উদ্দিন নিজামী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার সময়ের যথেষ্ট দাম আছে। আমি যে রিপোর্টটা দেখবো, সেখানে আমার সময় ব্যয় হবে না? সেটার পারিশ্রমিক আমি নেবো না? আমি তো ব্যবসা করতে এসেছি, জনসেবা করতে না।’

রিপোর্ট দেখতে ডাক্তারদের বাড়তি টাকা নেওয়া বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও প্রায়ই অনেককে সমালোচনামুখর হতে দেখা যায়। অনেকে খোলাখুলিই জানান ক্ষোভ। এমনই এক ঘটনায় ডা. সাইফ উদ্দিন নিজামীর নাম উল্লেখ করে চট্টগ্রামের সাংবাদিক রেজাউল করিম লিখেছেন, ‘এই চিকিৎসক ৭০০ টাকা ফি নিয়ে যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন সেই প্রেসক্রিপশনেরই অংশ এই রিপোর্ট। রিপোর্ট দেখেই তবেই তিনি ওষুধ লিখবেন— এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য আবার কেন ফি! ঢাকা-চট্টগ্রামে আমি অনেক বড় বড় স্বনামধন্য চিকিৎসকদের সম্পর্কে জানি, দেখেছি। তারা কেউ রিপোর্ট দেখার জন্য কোন ফি নেন না। রিপোর্ট দেখার ফি নেওয়াকে প্রকৃত চিকিৎসকরা নিজেরাও নৈতিকতা বিরোধী বলে মনে করেন। কিন্তু উল্লেখিত চিকিৎসক নৈতিকতাবিরোধী এই কাজটি করে যাচ্ছেন অসহায় চিকিৎসাপ্রত্যাশী রোগীদের সাথে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. আমির হোসেনের ফি ১ হাজার টাকা। রিপোর্ট দেখানোর ফি আরও ২০০ টাকা। তিনি রোগী দেখেন সিএসসিআরে। একাধিক রোগীর কাছ থেকে অভিযোগ মিলেছে, পরবর্তীতে কোনো রোগী তিন মাস পর আসলে তখন তিনি আবারও কিছু টেস্ট ধরিয়ে দেন। রোগীকে ওই রিপোর্ট দেখাতেও আবার নতুন করে ফি দিতে হয়।

রিপোর্ট দেখতে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে ডা. আমির হোসেন বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত প্রাকটিস করি। এটা আমার নিয়ম। রিপোর্ট দেখতেও মেধা ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। তবে সেটার ফি থাকবে না কেন?’

চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি সার্জিস্কোপ হাসপাতালে বসেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল কালাম আজাদ। তিনি রিপোর্ট দেখতে ৫০০ টাকা নেন। তার ফি ১ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে ১৫০০ টাকা।

অন্যদিকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলামের ভিজিট ৮০০ টাকা। তবে রিপোর্ট দেখতে নেন ৫০০ টাকা। সবমিলিয়ে ১৩০০ টাকা।

এপিক হেলথ কেয়ারে বসেন নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. সাইফুল আলম। তার ফি ১ হাজার টাকা। তিনি রিপোর্ট দেখতে নেন ৩০০ টাকা।

ল্যানসেট ডায়াগনস্টিক এন্ড রিসার্চ সেন্টারে দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রোগী দেখেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. আলী আসগর চৌধুরী। তার ভিজিট ৮০০ টাকা। রিপোর্ট দেখতে তিনি নেন ৩০০ টাকা।

এপিক হেলথ কেয়ার সেন্টারে চেম্বার করা কিডনি রোগ ও ডায়ালাইসিস বিশেষজ্ঞ ডা. সৈয়দ মাহতাব-উল-ইসলাম ভিজিট নেন ৮০০ টাকা। রিপোর্ট দেখাতে এক সপ্তাহ পর আসলে নেন ৩০০ টাকা। দুই সপ্তাহ পর আসলে সেটির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ টাকা।

অর্থোপেডিক সার্জন মোহাম্মদ আবদুল হাই এপিক হেলথ কেয়ারে বসেন। তিনি নির্ধারিত ৭০০ টাকা ভিজিট ছাড়া রিপোর্ট দেখাতে ৭ দিনের মধ্যে হলে ৩০০ টাকা নেন। রিপোর্ট দেখাতে ১৫ দিনের মধ্যে হলে ৫০০ টাকা।

সাবেক সিভিল সার্জন ও বর্তমানে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এ বিষয়ে বলেন, ‘রিপোর্ট দেখতে ফি নেওয়ার বিষয়টি ডাক্তারদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। তবে রিপোর্ট দেখতে রোগীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া অনৈতিক। আসলে যতদিন ডাক্তারদের ফি নিয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত হবে না, ততদিন এ সমস্যার সমাধানও মিলবে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!