ছয়জনের হুমকিতে পুরুষশূন্য বাঁশখালীর জেলেপাড়া

২০০ বছরের প্রাচীন বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম নাপোড়া কৈবত্য পাড়া। এটি জেলেপাড়া নামেও পরিচিত। সংখ্যালঘু হওয়ায় প্রায়ই প্রকাশ্যে নির্যাতন, লুটপাট ও হুমকিতে কখনও ফিশিং বোট, কখনও জায়গা-জমি, কখনও টাকা-পয়সা, কখনও স্বজন হারিয়েছে তারা। তাই পাড়ার বেশ কয়েকটি পরিবার ভয়ে ও আতঙ্কে ভারতের দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কাকদ্বীপসহ পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। এরপরও এখনও অর্ধশতাধিক পরিবার জেলে পেশাকে সম্বল করে বেঁচে আছে।

এরপরও তাদের ভয় কাটে না। সর্বশেষ গত ১ জুন ও ১০ জুন ওই পাড়ায় প্রকাশ্যে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে ৩০-৪০ জনের একটি দুস্কৃতি চক্র। এ সময় ওই চক্রটি প্রকাশ্যে পাড়ার অর্ধশতাধিক গাছ কেটে নিয়ে গেছে এবং পুকুরে জাল ফেলে দেড় লক্ষাধিক টাকার মাছ লুট করে নিয়ে গেছে। বাধা দিতে গেলে ৬ নারী ও ২ পুরুষকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দিয়েছে দুস্কৃতিকারীরা। ভেঙে দিয়েছে পারিবারিক শ্মশানের মন্দিরও।

স্থানীয়রা জানান, হামলার পর সশস্ত্র দুস্কৃতিকারীরা রাস্তায় পাহারা বসিয়ে আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিতেও বাধা দিয়েছে। কৌশলে ভিন্নপথে পালিয়ে গিয়ে বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুজন এবং ৬ জন পেকুয়া উপজেলার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। থানায় মামলা করা হলে জায়গা-জমি ছেড়ে ভারত চলে যেতে হবে, নয়তো পুরো জেলেপাড়া জ্বালিয়ে প্রাণে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে দুস্কৃতিকারীরা। তাদের সশস্ত্র মহড়া এবং হুমকিতে ঘটনার এক মাস পরও পুরুষরা স্বাভাবিকভাবে ঘরে থাকতে পারছে না। ফলে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো জেলেপাড়া।

ছয়জনের হুমকিতে পুরুষশূন্য বাঁশখালীর জেলেপাড়া 1

এসব অভিযোগ নিয়ে গত ৪ জুলাই নাপোড়া জেলেপাড়ার বাসিন্দারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার, বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) ও বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে জানা গেছে।

জেলেপাড়ার তপন দাস, দীপংকর দাস, বাসন্তি দাস, রবি চাঁদ দাস, সাধন দাসসহ অনেকে অভিযোগ করে বলেন, ‘জেলে পাড়াটি ২০০ বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষের জায়গা। কিন্তু কোনো দলিল ছাড়া বিএস জরিপে কৌশলে জায়গার খতিয়ান বানিয়ে আমাদের পৈত্রিক বসতভিটার ১১৮ শতক জায়গা দখলের চেষ্টা করছে জেলেপাড়া থেকে ২ কিলোমিটার দূরের গ্রামের জয়নাল আবেদীন ও মীর মো. কামাল উদ্দিনসহ ছয় ব্যক্তি।

তারা বলেন, বিষয়টি জেনে আদালতের স্মরণাপন্ন হলে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই বাঁশখালীর সিনিয়র সহকারী জজ আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেন। বিএস জরিপ ভুল বলে সিদ্ধান্ত দেন। এরপর থেকে তারা নানাভাবে হুমকি দিয়ে আমাদের জায়গা দখলের চেষ্টা করছে।

তারা আরও জানান, গত ১ জুন সশস্ত্র অবস্থায় ৩০-৪০ জন লোক প্রকাশ্যে পুকুরের দেড় লক্ষাধিক টাকার মাছ লুট করে এবং পুকুরপাড়ের অর্ধশতাধিক গাছ কেটে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে বাঁশখালী থানায় অভিযোগ দিলে দুস্কৃতিকারীরা ১০ জুন আবার আমাদের পাড়ায় সশস্ত্র হামলা চালায়। তখন আবারও গাছ কেটে নেয় ও পুকুরের মাছ লুট করে। ওই সময় তাদের তাণ্ডবে প্রাণ বাঁচাতে পুরুষরা পাড়া থেকে পালিয়ে যায়। আর এই সুযোগে মহিলাদের ওপর হামলা চালায় এবং পারিবারিক শ্মশানের মন্দির ভেঙে দেয়। এমনকি আহতদের চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যেতেও বাধা দেয় রাস্তায় পাহারা বসিয়ে। পরে পালিয়ে ভিন্নপথে তারা চিকিৎসা নিয়েছে।

ওই ঘটনায় আহতরা হলেন বরুনা দাস (৪৮), সমিতা দাস (৫০), বেঞ্চু দাস (৪৬), দেবকী দাস (৪৫), ডেজী দাস (২৮), মঙ্গলী দাস (৪৮), ফকির চাঁদ দাস (৩৮) ও হরিসেন দাস (৩৫)।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘জেলেপাড়ায় আমরা হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট করিনি। আমাদের জায়গা উদ্ধারে গিয়েছিলাম। ওই জায়গাগুলো আমাদের। আমরা কাউকে হুমকি-ধমকিও দিচ্ছি না।’

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার বলেন, ‘আমার কাছে দেওয়া অভিযোগ আমি থানায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’

সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) মফিজুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি বাঁশখালী থানা পুলিশ সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করছে। দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জেলে পরিবারের নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ তৎপর আছে। কোন দুস্কৃতিকারী হুমকি-ধমকি দিয়ে কারও জায়গা-জমি দখল করতে পারবে না।’

এসএ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!