চট্টগ্রাম শহরে না খেয়ে ঘুমাতে যায় ৯.২৩ ভাগ পরিবার

সরকারি সংস্থার জরিপের তথ্য

১৪ বছরের নয়নের পরিবারে আছে আরও এক ভাই ও ছোট এক বোন। থাকে তারা চট্টগ্রাম পুরোনো রেলওয়ে স্টেশনের সামনে। খুঁটি টাঙ্গিয়ে ওপরে পলিথিন দিয়ে তৈরি করা ঘরে থাকে মাও ওরা তিন ভাইবোন। বাবা মারা গেছেন বছরদুয়েক আগে। বাবা নোয়াখালী শহরে ফেরিওয়ালার কাজ করত। বাবা অসুখে পড়লে বাড়ির জায়গা বন্ধক রেখে চিকিৎসা চালায় বাবার। বাবা মারা গেলে বাড়িটা আর ফেরত নেওয়া হয়নি। মা ও ছোটভাইবোনদের নিয়ে চলে আসে চট্টগ্রাম শহরে। সেই নয়ন আঙ্গুলে বছর হিসেব করে জানায়, ‘তখন আমি আরও ছোট ছিলাম। স্টেশনে কুলিগিরির কাজ নিই। ট্রেন স্টেশনে আসলেই ছুটে যেতাম যাত্রীদের কাছে। দিনশেষে শ’দেড়েক টাকা এনে মায়ের হাতে তুলে দেই। মা বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। সবমিলিয়ে হাজারচারেক টাকায় সংসার চলে যায়।’

কিন্তু করোনায় লকডাউনের সময় সবকিছু যখন বন্ধ, নয়ন ও তার ভাইবোনরা মাঝেমাঝেই না খেয়ে থাকত। এখন লকডাউন উঠে যাওয়ার পর প্রতিদিন দুমুঠো ভাত কোনোমতে খেতে পারছে। কিন্তু বহু মাস ধরে মাছ-মাংস মুখে যায়নি তাদের।

এই গল্প কেবল নয়নদেরই নয়, তাদের পাশে ঝুপড়ির মত ঘর তুলে থাকা কাদের, মিলন, সোহাগদের গল্পও অবিকল এরকমই। মাসে একবারও একটুকু মাছ, এক টুকরো মাংস খাবার সাহসই তারা পায় না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার এরকম চিত্র ঢাকার পরেই। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও এখানে প্রচুর মানুষ বাস করছে দারিদ্রসীমার নিচে। মেলে না ঠিকমতো খাবার। অভুক্ত থেকে কাটাতে হয় দিন। রোগে মেলে না প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দ্য আরবান সোসিওইকোনোমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে (ইউএসএএস) নামের একটি জরিপ পরিচালনা করে এমন সব তথ্য পেয়েছে। গত বছরের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই জরিপটি চলে। এই ধরনের জরিপও এটিই প্রথম।

সরকারিভাবে পরিচালিত এই জরিপ থেকে জানা যায়, শহরের দরিদ্র পরিবারগুলোর আট শতাংশ এখনও ঘুমাতে যায় ক্ষুধার্ত পেটে। এতে আরও দেখা যায়, প্রায় ১২ শতাংশ দরিদ্র শহুরে পরিবারে খাবার নেই। অন্যদিকে শহরে ২১ শতাংশেরও বেশি পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই। জরিপে অংশ নেওয়া ২১ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন করোনাকালে অভাবে পড়ে তারা তাদের পছন্দের খাবার খেতে পারেননি।

এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়েছে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে। চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সিটি করপোরেশন এলাকার দুই হাজার ১৫০টি পরিবারের কাছ থেকে এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে। করোনাকালে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে— বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

জরিপে দেখা যায়, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। অন্যান্য শহর অঞ্চলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাওয়া মানুষের হার যেখানে চার দশমিক ৮৪ শতাংশ, সেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের শহরাঞ্চলে এই হার নয় দশমিক ২৩ শতাংশ।

জরিপে সারাদিনে একবেলাও খেতে পারেনি— এমন পরিবার পাওয়া যায় প্রায় তিন শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই হার তিন দশমিক ১৭ শতাংশ। এতে আরও দেখা যায়, সাত শতাংশ পরিবার কম খাবার খেয়েই দিন কাটিয়ে দিয়েছে। প্রায় ১৫ শতাংশ পরিবার অপছন্দের খাবার খাচ্ছে এবং ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ পরিবার খাবারের পরিমাণই কমিয়ে দিয়েছে।

জরিপে পাওয়া এই পরিস্থিতি করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগেকার সময়ের। গত ২৬ মার্চ করোনা হানা দেওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী ৬৬ দিনের লকডাউনের সময় অনেক স্বল্প আয়ের মানুষের আয় অনেক বেশি কমে গেছে, কাজ হারিয়েছেন অনেকে। তাদের ঘরে খাবারের কোনো মজুদও নেই। গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন মজুমদার বলেন, ২০১৬ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে জরিপটি চালিয়েছিল তাতে চট্টগ্রামের অবস্থান ভালো ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানার আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ এর তথ্য অনুযায়ী, সার্বিকভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের জনসংখ্যার ১৮.৪ শতাংশ ও ৮.৭ শতাংশ যথাক্রমে উচ্চতর ও নিম্নতর দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিল। সমগ্র দেশের জন্য এই হারগুলো ছিল যথাক্রমে ২৪.৩ শতাংশ এবং ১২.৯ শতাংশ।’

তিনি বলেন, ‘দারিদ্রের সূচকে চট্টগ্রাম বিভাগের আপেক্ষিক উন্নত অবস্থান এখান থেকে স্পষ্ট ছিল যে, ঢাকা (দরিদ্র ১৬.০ শতাংশ এবং চরম দরিদ্র ৭.২ শতাংশ) ছাড়া সবগুলো বিভাগ চট্টগ্রাম থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু গত বছরের জরিপে যে চিত্রটি উঠে এসেছে তা করোনাকালে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তাই দেশের নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়টি মাথায় রেখে ভেবে কাজ করা উচিত।’

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!