চট্টগ্রাম মেডিকেলে থেমে নেই অ্যাম্বুলেন্স বাণিজ্য, চড়া টাকা না পেলে রোগী ফেলে রাখে রাস্তায়

ইচ্ছেমতো টাকা আদায়, প্রতিবাদ করলে পেটানো হয় রোগীর স্বজনদের

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের আসকারাবাদের গৃহবধূ হাজেরা তার বাবা মোতালেব হোসেনকে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ব্রেইন স্ট্রোক করে দু’সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিলেন তার বাবা। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাবাকে নিজ বাসা আনার জন্য আ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেন তিনি। এক ওয়ার্ডবয়ের সহায়তা ‘চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি’র সভাপতি নূর মোহাম্মদ নুরুর নম্বর পান। তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন।

এরপর মেডিকেলের নিচে এসে স্ট্রেচারে রোগী আ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই বাধে বিপত্তি। নুরুর লোকজন ভাড়া চান সাড়ে চার হাজার টাকা। কিন্তু ফোনে নুরুর সঙ্গে কথা হয়েছিল ‘বিবেচনা করে যা দেন’ তাই নেওয়া হবে। হাজেরা সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে না চাইলে তার বাবাকে আ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা স্ট্রেচারসহ মাটিতে ফেলে রাখেন। তারপর সিএনজি অটোরিকশা করে রোগী আনা হয় বাসায়। ঘটনাটি বৃহস্পতিবারের (১৯ মে)।

এভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘিরে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে প্রতিদিন চলছে অমানবিক ব্যবসা। কোন অ্যাম্বুলেন্স যাবে, কোনটি লাশ পরিবহন করবে, ভাড়া কত—সবই নির্ধারণ করে দেয় সংঘবদ্ধ চক্র। তাদের কথার বাইরে গেলে দুর্ভোগ নেমে আসে রোগী ও স্বজনদের কপালে। এসব বিষয়ে বাকবিতণ্ডা এবং রোগীর স্বজনদের মারধর করার ঘটনাও ঘটেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ‘চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি’ নামের একটি সংগঠন খুলে এমন বাণিজ্য করে যাচ্ছেন সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ নুরু। বিশেষ করে মৃত রোগী পরিবহন নিয়েই তাদের বাণিজ্য বেশি। কোনো রোগী মারা গেলে তারা তাদের পছন্দ মতো কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করতে পারে না। সিন্ডিকেটের কাছ থেকেই নিতে হয় অ্যাম্বুলেন্স। যদি কেউ অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে নিয়ে আসে তাহলে তা ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না নুরু বাহিনী। আর অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াও নির্ধারণ করে দেয় এই চক্রের সদস্যরা। সেই অনুযায়ী ভাড়া না দিলে রোগীর স্বজনদের কপালে নেমে আসে দুর্ভোগ।

বৃহস্পতিবার (১৮ মে) সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গ ঘিরেও অমানবিক বাণিজ্য চলে অ্যাম্বুলেন্স সমিতির। ১৩০টি অ্যাম্বুলেন্স আছে এই সমিতির আওতায়। মেডিকেলের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে কোনো লাশ ময়নাতদন্তের জন্য অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে যেতে গলাকাটা দর হাঁকে নূরু সিন্ডিকেট। মাত্র ২০০ গজ দূরে মর্গে লাশ নিয়ে যেতে ভাড়া হাঁকে ১২০০ থেকে ১৫০০ হাজার। অনেক সময় নিম্নআয়ে মানুষের সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্যও থাকে না। আর টাকা দিতে না পারলে সমিতির অফিসে নিয়ে রোগীর স্বজনদের মারধরও করা হয়।

আরও জানা গেছে, লাশ পরিবহনের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার তালিকাও মানে না নুরু সিন্ডিকেট। এর আগে আনোয়ার হোসেন লিটন ছিলেন এই সমিতির সভাপতি এবং আকতারুজ্জামান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে রাখার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এই নুরু বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) অভিযোগ গেছে। কিন্তু অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে বারবার সে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির যৌথ উদ্যোগে রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। এজন্য চালকদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্তও আরোপ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ওই নীতিমালা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায়। এরপর করোনার সময় রোগী ও মরদেহ পরিবহনে ‘বাড়তি সতর্কতা’র অজুহাতে নেওয়া হয় তিনগুণ বেশি ভাড়া।

সেই নীতিমালা অনুযায়ী তিনটি ক্যাটাগরিতে নন-এসি, এসি ও ফ্রিজার ভ্যানের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ওই সময়। আসা-যাওয়া মিলে ১০ কিলোমিটার নন এসি ছোট ও বড় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ৯০০ টাকা, ২০ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ২০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ১ হাজার ৩০০ টাকা, ৩০ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৯০০ টাকা, বিমানবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ২ হাজার ২০০ টাকা এবং এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া আন্তঃনগরে নন-এসি ছোট গাড়ি (১৮০০ সিসির নিচে) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৪ টাকা, বড় গাড়ি (১৮০০ সিসি ও তার চেয়ে বেশি) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৭ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৯ টাকা, পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতি কিলোমিটারে ১০ শতাংশ বেশি এবং ফ্রিজার ভ্যানের ওয়েটিং চার্জ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রথম ঘণ্টা ফ্রি থাকার কথা নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এরপর বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টাকা, পরিবহনের বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ টাকা ও অক্সিজেনের জন্য নতুন সিলিন্ডার প্রতি ২২০ টাকা গ্রাহককে পরিশোধের নিয়ম চালু করা হয়। পাশাপাশি গাড়িগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং ও সর্বোচ্চ পাঁচটি গাড়ি পার্কিংয়ে অবস্থান করতে পারবে— এমন কথা উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয় অপেক্ষমাণ গাড়িগুলো সিরিয়াল অনুযায়ী ভাড়া পাবে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অস্বীকার করে চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ নুরু বলেন, ‘রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী স্বজনদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কী করেছে, তার দায়ভার আমি নেবো না। আমার দায়িত্বে থাকাকালীন কোনো অনিয়ম আমি করতে দেইনি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!