চট্টগ্রামে শেভরণের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়, তদন্তের নামে চলে সময়ক্ষেপণ

ভুল রিপোর্ট দেওয়া, আট বছর আগে মারা যাওয়া চিকিৎসকের নামে রিপোর্ট সরবরাহ, বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা আদায় ও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট (স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রণ) ব্যবহারের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের নামি ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণের বিরুদ্ধে। একাধিক অভিযোগ চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জমা পড়লেও এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

ফলে ভয়ডরহীনভাবে ভুল রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নামি এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভুল রিপোর্টের কারণে মৃত্যুর ঘটনার পাশাপাশি পঙ্গু হওয়ার নজিরও রয়েছে। মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে সংশ্লিষ্টদের এমন নিরবতা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন সমাজকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার করলে টেস্টে যথাযথ রিপোর্ট আসবে না। এমন রিপোর্টের ওপর চিকিৎসা নিলে রোগীর শারীরিক অবনতি হবে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

গত ১ মে পেটের ব্যথা নিয়ে শেভরণের জরুরি বিভাগের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আলট্রাসনোগ্রাফি ও এক্স-রে করান আমান উল্লাহ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এরপর ডাক্তার রিপোর্ট দেখে এপেন্ডিসাইটিস বলে শনাক্ত করেন এবং অপারেশন করানোর জন্য বলেন। পরে অন্য হাসপাতালের আরও দুই চিকিৎসকের পরামর্শে আবারও টেস্ট করান আমান। টেস্টে এপেন্ডিসাইটিসের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, পাওয়া যায় পিত্তথলীতে পাথর।

গত ১৭ জুলাই ডেঙ্গু পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ফি আদায় করায় অভিযোগে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। একদিন পর আবার ল্যাবটি খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় ল্যাবটির বিরুদ্ধে ৩০০ টাকার পরিবর্তে ডেঙ্গু এনএস ওয়ান পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৬০০ টাকা ও আইজিজি বা আইজিএম পরীক্ষার ফি ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছিল।

সর্বশেষ গত ২৬ আগস্ট রোকেয়া বেগম নামের এক রোগীকে শেভরণের দেওয়া ইকোকার্ডিওগ্রাফির রিপোর্টে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রেজাউলের নাম উল্লেখ ছিল। অথচ ওই চিকিৎসক মারা গেছেন ৮ বছর আগে। কিন্তু তার নামে রিপোর্ট দিয়েছে শেভরণ। এই ব্যাপারে অভিযোগও জমা পড়েছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসে।

এছাড়া গত বছরের ২২ সেপ্টম্বর শেভরণ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযানে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহারের প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অথচ শেভরণ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রথমে অস্বীকার করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির ফ্রিজেও মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ টাকা জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। কিন্তু এরপরও থেমে নেই শেভরণের ‘দুই নম্বরি’।

তারও আগে ২০২২ সালের আগস্টের শুরুর দিকে শেভরণ ও এপিকের দেওয়া ক্যান্সার শনাক্তের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে অপারেশন করা হয় আইনুর নাহার সীমা নামে এক গৃহবধূকে। অপারেশনের পর সীমার শরীর পাওয়া টিস্যু চট্টগ্রামেরই অন্য একটি বিশেষায়িত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, সেখানে ক্যান্সারের কোনো উপস্থিতিই নেই। কিন্তু অপারেশন-পরবর্তী তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ওই গৃহবধূ ১৯ আগস্ট মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মো. ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। তবুও প্রতিদিন বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে, এমনকি বন্ধের দিনেও অভিযান চলছে। অভিযোগের ভিত্তিতে শীঘ্রই আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।’

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শেভরণের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করছি। প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তাদের বিরুদ্ধে ডেঙ্গু টেস্টে বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল। ওই অভিযোগের কারণে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’

অভিযোগের বিষয়ে শেভরণ ক্লিনিক্যাল ল্যাবের জেনারেল ম্যানেজার পুলক পারিয়াল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর অভিযোগের বিষয়ে আমরা জানি না। এমন কোনো চিঠি সিভিল সার্জন অফিস থেকে আমাদের কাছে আসেনি।’

অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোবাইলে কথা বলতে চাই না। কথা বলতে চাইলে কাগজপত্র নিয়ে অফিসে আসেন।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!