চট্টগ্রামে মেট্রোরেল/ ৮৪ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী প্রস্তাবনা

চট্টগ্রাম মহানগরীতে দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থা মেট্রোরেল চালুর জন্য ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। এই রিপোর্টে চট্টগ্রাম শহরে প্রতি ১০ মিনিটে একটি মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া যথেষ্ট বলে মনে করছেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম শহরে সাড়ে ৫৪ কিলোমিটারের তিনটি মেট্রোরেল লাইন স্থাপনের প্রস্তাবনা দিয়েছে।

জানা গেছে, প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল লাইন স্থাপনে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। ফলে সাড়ে ৫৪ কিলোমিটারে তিনটি মেট্রোরেল লাইনে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৮৪ হাজার ২০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তিনটি লাইনে মোট ৪৭টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি মেট্রোরেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার এবং গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪৫ কিলোমিটার। একটি ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটির মাধ্যমে ঘন্টায় এর দুই প্রান্তের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী উভয়দিকে পরিবহন করা সম্ভব।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে হলে গণপরিবহনের উন্নয়ন, স্টেশনের বহুমুখি বাণিজ্যিক ব্যবহার, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস, কর্মঘন্টা সাশ্রয়ের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এমআরটি প্রকল্পের জন্য আরো আলোচনা ও সেবা সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা উচিত হবে না বলে তারা মনে করেন।’

প্রসঙ্গত, প্রায় ছয় মাস আগে মেট্রোরেল চালুর ব্যাপারে মতামত চেয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) পত্র দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চট্টগ্রাম শহরে মেট্রোরেল চালু করা যেতে পারে বলে মতামত দিয়েছিল চসিক। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শহরে এমআরটি নির্মাণের প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষার জন্য বাসস্থান ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কন্সল্ট্যান্টস লিমিটেড নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকার ওয়ার্ক অর্ডার দেয় চসিক।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিধান চন্দ্র ধর, বুয়েটের ড. সোহরাব উদ্দিন, ড. এম আজাদুর রহমান, ডিমটিসি এমআরটি লাইন-৬ এর প্রাক্তন অতিরিক্ত পরিচালক, মো. মাহবুবুল আলমসহ ২৫ জনের উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টিম প্রায় ছয়মাস সমীক্ষা চালিয়ে প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। আগামী দু’এক সপ্তাহের মধ্যে টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট প্রজেক্ট প্রোফর্মা (টিএপিপি) রিপোর্ট দাখিল করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।

শুক্রবার (২৬ জুলাই) বিকালে চসিকের সম্মেলন কক্ষে সমীক্ষার প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। উপস্থিত ছিলেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা (রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান)।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে, তিনটি এমআরটি লাইনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। সাড়ে ২৬ কিলোমিটারের এমআরটি লাইন-১ (কালুরঘাট-বহদ্দারহাট-চকবাজার-লালখানবাজার-দেওয়ানহাট-পতেঙ্গা-বিমানবন্দর), সাড়ে ১৩ মিলোমিটারের এমআারটি লাইন-২ (সিটি গেট-একে খান বাস স্টপ-নিমতলী বাস স্টপ-সদরঘাট-ফিরিঙ্গিবাজার-শহীদ বশিরউজ্জামান স্কয়ার) এবং সাড়ে ১৪ কিলোমিটারের এমআরটি লাইট-৩ (অক্সিজেন-মুরাদপুর-পাঁচলাইশ-আন্দরকিল্লা-কোতোয়ালী-ফিরিঙ্গিবাজার এবং পাঁচলাইশ-একে খান বাস স্টপ লিঙ্ক।

লাইন-১ এ ২০টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলো- কালুরঘাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও সিএনবি বাস স্টপ, হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, চকবাজার, জহুর আহমেদ চৌধুরী রোড, লালখানবাজার, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বারিক বিল্ডিং, নিমতলী, সল্টগোলা ক্রসিং, সিইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, স্টিল মিল বাস-স্টপ, পতেঙ্গা, পতেঙ্গা বীচ এবং এয়ারপোর্ট।

লাইন-২ এ ১২টি স্টেশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলো- সিটি গেট, কর্নেল হাট গেট, একে খান বাস স্টপ, সরাইপাড়া, নয়াবাজার, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট নিউ মার্কেট, নিমতলী, বারিক বিল্ডিং, সদরঘাট, ফিরিঙ্গিবাজার এবং শহীদ বশিরউজ্জামান স্কয়ার।

লাইন-৩ এ ১৫ স্টেশনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- অক্সিজেন, হাশেম বাজার রোড, মুরাদপুর, চকবাজার, চন্দনপুরা, আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালী, ফিরিঙ্গিবাজার এবং পাঁচলাইশ-একে খান বাস স্টপ লিঙ্কে পাঁচলাইশ, মেডিকেল, জিইসি স্কয়ার, বিজিএমইএ ইনস্টিটিউট, ফয়ে’স লেক, পাহাড়তলী লিঙ্ক রোড এবং একে খান স্টপ।

প্রতিটি এমআরটি লাইনের জন্য একটি ডিপো স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি ডিপোর জন্য প্রায় ৬০ একর জমি প্রয়োজন হবে। ডিপোতে রোলিং স্টকের (রেল-কার) বিরতিকালীন বিশ্রাম, প্রাত্যহিক পরিষ্কারকরণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, অপারেশনাল কন্ট্রোল রুম সেন্টার (ওসিসি), স্টেব্লিং ইয়ার্ড, বহুমুখী ওয়ার্কশপ, পাওয়ার সাব-স্টেশন, ওয়াশিং ইউনিট এবং আনুষঙ্গিক অফিস ও ডর্মিটরি, উদ্ধারকারী ক্রেইন স্টেশন, এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি টেস্ট ট্র্যাক।

লাইন-১ এ বহদ্দারহাট-লালখানবাজার সড়কে সিডিএর ফ্লাইওভার এবং লালখানবাজার-বিমানবন্দর সড়কে পতেঙ্গা থেকে ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজকে প্রকল্প সম্পাদনে প্রতিবন্ধকতা ধরা হয়েছে। এ প্রতিবন্ধকতা সমাধান বিকল্প পথে বহদ্দারহাট-বাদুরতলা-কাপাসগোলা-চকবাজার-কাজীর দেউড়ি-লালখানবাজার লাইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর জন্য লালখানবাজার-বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভার কাজ স্থগিত অথবা ডিজাইন পুনর্বিবেচনা করে সমন্বয় করে অথবা ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে এমআরটি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে মেট্রোরেল লাইন স্থাপন এ নগরীর জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিবে।

সমীক্ষায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, ক্রমঃবর্ধমান যানবাহন সমস্যা সমাধান, সুলভে গণপরিবহনের ব্যবস্থা, গণপরিবহনে উচ্চ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ও দ্রুত গতির রেলের প্রচলন, পরিবহনে সড়ক নির্ভরশীলতা হ্রাস করে যানজট কমিয়ে আনা, যাত্রার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভ্রমণকাল হ্রাস করা ও সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো নিশ্চিত করা, ভ্রমণ ব্যয় যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে রাখা, পরিবেশ দূষণ হ্রাস করা, একই সমতলে সড়ক এবং রেলের ক্রসিং পরিহার করে উভয়ের গতিশীলতা নিশ্চিত করা।

চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে নগর পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, প্রকৌশলী মো. হারুন, স্থপতি নাজমুল লতিফ, সিডিএর বোর্ড মেম্বার আশিক ইমরান, আইবি সভাপতি রফিকুল আলম, পরিবহন বিশেষজ্ঞ সুভাষ বড়ুয়া, পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন, চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন উদ্দিন আহমেদ, প্রধান পরিকল্পণাবিদ একেএম রেজাউল করিম, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস্ বক্তব্য রাখেন।

এমএ/এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!