চট্টগ্রামে কানের রোগী বাড়িয়ে দিল করোনা এসে, মেডিকেলে চাপ প্রতিদিনই

মাত্রাছাড়া মোবাইলই সর্বনাশ করেছে

বৃহত্তর চট্টগ্রামের নাক গান গলার চিকিৎসায় একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল হল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের বহির্বিভাগ। সপ্তাহের ছয়দিনই সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত রোগীর এত বেশি চাপ থাকে বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, ইদানিংকালে বেশিরভাগ রোগীর একটা সমস্যাই দেখা যাচ্ছে অনেকটা গণহারে। আর সেটি হলো কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ করা। এছাড়া আছে কান ব্যথা, কানে কম শোনা, কানের ক্ষত ইত্যাদি সমস্যা।

চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, করোনাকালীন লকডাউন ও অসুস্থতায় ঘরবন্দি মানুষ মোবাইলকে সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে নেন ব্যাপকহারে। করোনার প্রকোপ কমার পরও মানসিক অবসাদ কাটাতে অনলাইন চ্যাট, ভিডিও গেমস বা ওয়েব সিরিজের মধ্যে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন অনেকে। আবার যারা চাকরি করছেন বা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত— তারা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় কনফারেন্স কল, অডিও-ভিডিও কলে ব্যস্ত থাকছেন বেশি। আবার ব্যবসা ধরে রাখতেও অনেকে এসেছেন ভার্চুয়াল জগতে। আর এতে চাপ পড়েছে কানের ওপর। চিকিৎসকরা বলছেন, এতো বেশি ফোনের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলছে কানের সমস্যা। এর কুপ্রভাবে অনেকেই কানে ভাল করে শুনতে পাচ্ছেন না বা কম শুনছেন। কারও আবার খুব কাছের শব্দকে দূরের বলে মনে হচ্ছে। অনেকেই কানের পাশে কেমন একটা ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ শুনছেন। কানের ব্যথায়ও ভুগছে অনেকে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভিমত, অতিরিক্ত কথা বললে মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশনের প্রভাবে কম বয়সেই হ্রাস পেতে পারে শ্রবণশক্তি। চলে আসতে পারে সাময়িক বধিরতা, যা স্থায়ীও হতে পারে। মস্তিষ্কের নানা সমস্যাও দেখা দিতে পারে। খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের ব্যাঘাত বা শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পিছনেও দায়ী কানের নানা সমস্যা।

এ ছাড়াও মোবাইল ব্যবহারের সময়ে শব্দ যেহেতু মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে কানে পৌঁছায়, তাই তা সরাসরি আঘাত করতে পারে মস্তিষ্কের কোষে। ফলে এ থেকেও মাথা যন্ত্রণা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতাল ছাড়াও কানের ডাক্তারদের চেম্বারেও যাচ্ছেন নানা সমস্যা নিয়ে অসংখ্য রোগী। কানের ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ শব্দের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে— এমন কথা বলছেন অনেক ভুক্তভোগী।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলার বহির্বিভাগে পাওয়া গেল রবিউল ইসলামকে। বাড়ি তার হাটহাজারীতে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসজীবন কাটানোর সুবাদে বউ-বাচ্চাদের সাথে সারাদিন ইমোতে কথা বলতেন। আর এ কথা বলার কারণেই কানের বিভিন্ন সমস্যা তিনি এখন টের পাচ্ছেন।

রবিউল ইসলামের সাথে কথা বলতে গিয়ে একই কথা তাকে কয়েকবার শোনাতে হয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেল, তার কানের কাছে অনবরত ভোঁ ভোঁ করে শব্দ হয়। কথাগুলো প্রতিবিম্বিত হয়। ডাক্তার জানিয়েছেন, তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। কোনোভাবেই মোবাইলে কিংবা জোরে শব্দ করে কথা বলা যাবে না। কোলাহল থেকেও দূরে থাকতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের ৬ দিনই কানের রোগীরা আসছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে। কেউ কেউ আসছেন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। চট্টগ্রামের বাইরের রোগীদেরও দেখা গেল নাক-কান-গলার বহির্বিভাগে। জানা গেছে, প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০ জন রোগীও চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে।

দীর্ঘ দুই যুগ ধরে ড্রাইভিং পেশার সঙ্গে জড়িত সাইফুল ইসলাম। মাঝে তিনি আক্রান্ত হন করোনায়। সাইফুল ইসলাম জানান, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর থেকে অনবরত তিনি কানের মধ্যে একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শব্দ শুনতে পান। কখনও কখনও সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজের মতও লাগে সেই শব্দ। সাথে মাথাব্যথাও করে।

তিনি জানান, অনেকদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে দূরপাল্লার গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। গাড়ির হরণের বিকট শব্দ তার কানের ক্ষতি করেছে। যা প্রথমবার প্রকাশ পেল করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরপরই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সঞ্জয় দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মোবাইল ফোনে কথা বলা বা হেড ফোনে নিয়মিত যারা গান শোনেন তার মধ্যে অনেকেই কানের বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে— কানে কম শুনতে পাওয়া, কানে শো শো বা বো বো শব্দ হওয়া, কানে ভারী ভাব অনুভূত হওয়া ইত্যাদি। এর বাইরেও অনেকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মাথার ব্যথা, মাথায় ভারী ভাব অনুভূত হওয়া কিংবা মাথা ঘোরানোর সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং বয়স ১৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। পুরুষদের মধ্যে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে।

এদিকে মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে চলছে গবেষণা। এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেমন ভারতের গুজরাট মেডিকেল জার্নালে ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গুজরাটে ২০০০ সালের পর থেকে ‘প্যারোটিড টিউমার’ বা মানবশরীরের প্রধান লালা গ্রন্থির টিউমারের হার প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে— যার পরোক্ষ কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা মোবাইল ফোনের ব্যবহারকে দায়ী করছেন। এছাড়া মোবাইলের রেডিয়েশনের কারণে ত্বকের বিভিন্ন ক্যানসারের হার বেড়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় মত প্রকাশ করা হয়েছে।

শিশুদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে দৃষ্টিক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, মস্তিষ্ক সঠিকভাবে বেড়ে না ওঠা, দেরিতে কথা বলা এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধীতার মতো সমস্যাও বেড়েই চলেছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!