গ্রেপ্তার ঠেকাতে সড়কে পিলার বসালেন ২৯ মামলার আসামি বাঁশখালীর সেই লিয়াকত

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গন্ডামারার সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী চারটি গ্রামীণ সড়কে পিলার বসিয়েছেন। ফলে তাকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি সড়ক দিয়ে প্রবেশ করতে পারছে না। দু’মাস ধরে এভাবেই অনেকটা ‘গৃহবন্দি’ হয়ে রয়েছেন ২৯ মামলার এই আসামি। আর রাতে সামিয়ানা টাঙিয়ে বাড়ির উঠোনে পুঁথির আসর বসানোর নামে চলছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।

জানা গেছে, গন্ডামারা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কামারুপাড়া ও মাঝির বাপের বাড়ির চারটি গ্রামীণ সড়ক গত ৬৯ দিন ধরেই পাকা পিলার আঁড়াআঁড়িভাবে ফেলে গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন তিনি। একইসঙ্গে এলাকার লোকজনেরও চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ ও র্যা বের গাড়ি যাতে লিয়াকতকে গ্রেপ্তারে সড়ক দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য পিলার বসিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিদিন ‘Md. Liaquat Ali’ নামে ফেসবুক আইডি থেকে নারী-পুরুষ নিয়ে জনসমাগমের একাধিক ভিডিও ও ছবি তিনি পোস্ট করেন। গত ২৯ নভেম্বর রাতে র ্যাব-পুলিশ অভিযানে গিয়ে ব্যর্থ হবার পর রাত ২টা ৮ মিনিটে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘যতই ভয় দেখান গন্ডামারা থেকে বের হবো না-আমার জানাজার মানুষগুলোর সামনেই আমাকে মারতে হবে।’

এছাড়া তার অন্যতম শিষ্য আবু আহমদের সঙ্গে ব্যবসায়িক টাকা ও জায়গার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের পর থেকে দু’পক্ষই এলাকায় মহড়া দিচ্ছেন। গভীর রাত পর্যন্ত এলাকার নারী-পুরুষ নিয়ে পাল্টাপাল্টি গুলি ছুঁড়ে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছেন।

জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে লিয়াকত আলীকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তিনি দক্ষিণ জেলা বিএনপি যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। পরে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে দলের পদটিও হারান তিনি। তার অন্যতম শিষ্য আবু আহমদ বাঁশখালী উপজেলার ছাত্রদল নেতা ছিলেন। দু’জনে বাঁশখালীর গন্ডামারায় ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে ব্যাপক সংঘর্ষ লাগিয়ে আলোচিত ছিলেন। এতে পৃথক পৃথক সময়ে ১৩ জন নিহত হয় ও শতাধিক শ্রমিক আহত হয়। পরে কয়লা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে বালি সরবরাহ, জায়গা ক্রয়, স্ক্র্যাপ ব্যবসা, শ্রমিক সরবরাহ ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা করে কয়েক শত কোটি টাকা আয় করেন। পরে ৭৫ একর খরিদা জমির মালিক হয়ে যান। এরপর টাকা ও জমির ভাগাভাগি নিয়ে দু’জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

সরেজমিন লিয়াকতের এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রসহ মো. লিয়াকত আলীকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর গত ১৩ জুন জামিনে আসেন তিনি। পরে পুরনো হত্যা মামলাগুলোর ওয়ারেন্ট ইস্যু হয় এবং নতুন করে হাটহাজারী ও বাঁশখালী থানায় আরও দুটি মামলা হয়।

গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, র ্যাব ও পুলিশ বেশ কয়েকবার লিয়াকত আলীর বাড়ির পাশে অভিযান চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি যাতে সড়ক দিয়ে ঢুকতে না পারে, সেজন্য গাড়ি চলাচলের ৪ জায়গায় রাস্তার মাঝখানে পাকা পিলার বিছিয়ে রেখেছেন লিয়াকত আলী। প্রতিরাতে জনসমাগম করে সরকারবিরোধী অপপ্রচার ছড়াচ্ছেন ফেসবুকে। যেকোনো মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে। আমি বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েছি।

বাঁশখালীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমি সবে মাত্র যোগদান করেছি। গন্ডামারার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে রয়েছে। সন্ত্রাসী যেই হোক, অপরাধ দমন করা হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী বলেন, আমি সন্ত্রাসী নই। আমাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপরও ফ্যাসীবাদি সরকার আমাকে হত্যা করার জন্য চক্রান্ত করছে। আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রতিটি মামলা মিথ্যা। আমাকে গ্রামবাসী ভালবাসে, তাই গ্রামবাসী আমাকে বাঁচানোর জন্য প্রতিরাতে ঘিরে রাখে।

তিনি বলেন, জনসমাগম খারাপ উদ্দেশ্যে নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে গ্রেপ্তার করতে চায়। আমার বিরুদ্ধে আরও দুটি মিথ্যা নাশকতার মামলা করা হয়েছে বাঁশখালী ও হাটহাজারী থানায়। আরও কোথাও মামলা হয়েছে কিনা, জানি না।

এ বিষয়ে জানতে লিয়াকতের শিষ্য হিসেবে পরিচিত আবু আহমদের মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বাঁশখালীর গন্ডামারা কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ফয়জুর রহমান বলেন, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অতীতের ঘটনা শেষ হয়ে গেছে। এখন কোনো ধরনের অপঘাত বাইরের কেউ করার সুযোগ নেই। কারণ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারদিকে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হয়েছে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে।

লিয়াকতের কাঁধে ২৯ মামলা

বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা লিয়াকত আলীর কাঁধে এখন ২৯টি মামলা। লিয়াকতের আলোচিত মামলাগুলো হলো ১৯৯৪ সালে গন্ডামারার আবু তাহের ও ১৯৯৯ সালে গন্ডামারার নুরুল কবিরকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গন্ডামারা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাঁদা দাবি করে হামলা চালিয়ে মর্তুজা আলী, মো. আংকুর, জাকের আহম্মদ ও জাকের হোসেনসহ ৬ জনকে গুলি করে হত্যা, ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ আলীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে শ্রমিক অসন্তোষ ঘটিয়ে গুলি করে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার আব্দুল মান্নানের ছেলে রাজিউল ইসলাম (২৫), মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল এলাকার আব্দুল মালেকের ছেলে শিমুল আহমেদ (২৩), কিশোরগঞ্জের ফারুক আহমদের ছেলে মাহমুদ হাসান রাহাত (২২), চুয়াডাঙ্গার অলি উল্লাহর ছেলে মো. রনি হোসেন(২৩), নোয়াখালীর আব্দুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান (১৯), চাঁদপুরের মো. নজরুলের ছেলে মো. শুভ (২২), বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনার মওলানা আবু ছিদ্দিকির ছেলে মাহমুদ রেজাকে (১৯) হত্যাসহ শতাধিক শ্রমিককে আহত করার মামলা, ২০২৩ সালে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার, ২০১৪ সালে অস্ত্র আইনে মামলা, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক আইনে মামলা।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!