আইআইইউসিকে যেভাবে ‘লুটের মাল’ বানায় জামায়াত নেতারা, ৫ কোটি টাকা হাতানোর প্রমাণ

দিনের পর দিন চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি) থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে নগদেই। এই লোপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রতিষ্ঠানটির টাকায় এমনকি চালানো হচ্ছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত মামলার কার্যক্রমও।

গত মার্চে আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন করে সরকার। প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীকে চেয়ারম্যান করে ১৯ সদস্যের এই ট্রাস্টি বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই জামায়াত নেতাদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়। প্রাথমিক তদন্তেই জামায়াত নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে অবিশ্বাস্য সব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ।

শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক আ জ ম ওবায়দুল্লাহ এই প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু চাকরি না করেই তিনি তুলে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা বেতন। এ কারণে তাকে শোকজ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাওলানা শামসুল ইসলামের পিএস শফিউল আলমও চাকরি না করে বেতন তুলে নিতেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে।

২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালখান বাজারে জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ বোমার কারিগর নুরুন্নবী ওই সময় আহত হন ঘটনাস্থলেই। নুরুন্নবী ছিলেন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন নায়েবে আমির এবং নেজামে ইসলামের একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি ইজাহারের মাদ্রাসার জঙ্গী প্রশিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এই নুরুন্নবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল জামায়াত নেতা শামসুল ইসলামের পিএস শফিউল আলমের।

এদিকে একাউন্টস এন্ড ফাইন্যান্স ডিভিশনের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মোহাম্মদ শহিদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক নথি থেকে জানা গেছে, আইআইইউসি থেকে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে শামসুল ইসলাম ৬৩ লাখ টাকা, সাবেক এফসি চেয়ারম্যান জনাব প্রফেসর আহসানুল্লাহ ৭০ লাখ টাকা, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান ৭০ লাখ টাকা ও বিদেশ বিভাগের কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। যে টাকার কোনো ভাউচার অথবা হিসাব অদ্যাবধি অর্থ ও হিসাব বিভাগে তারা জমা প্রদান করেননি।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির বিদেশ বিভাগের কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন জামায়াত ইসলামের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার বায়তুল মাল সম্পাদক। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকায় বিভিন্ন সহিংসতায় জড়িত জামায়াত নেতাকর্মীদের মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইআইইউসির ৬০ লাখ টাকা তুলে নেন।

এছাড়া অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) তৌফিকুর রহমান ৩৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৫ টাকা নগদ নিয়েছেন। যে টাকা তিনি হিসাব বিভাগে ফেরত দেননি। এই টাকা তিনি ফ্ল্যাট কেনা এবং খামারবাড়ির প্রয়োজনে উত্তোলন করেছেন। যার নথি আইআইইউসির হিসাব শাখায় সংরক্ষিত রয়েছে। ১৮ মাসে সাবেক প্রক্টর ড. কাউসার আহমেদ ৫ লাখ ৭০ হাজার ২৮০ আপ্যায়ন বিল তুলে নেন।

একাউন্টস এন্ড ফাইন্যান্স ডিভিশনের সিনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর জয়নুল আবেদিন স্বাক্ষরিত অপর এক নথিতে দেখা গেছে, সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শামসুল ইসলামের জন্য গাড়ি কেনার কথা উল্লেখ করে তাঁর পিএস শফিউল আলম দুই দফায় মোট ৩০ লাখ টাকা তুলে নেন। এই টাকার অ্যাডজাস্টমেন্ট বিল দিলেও যথাযথ পর্ষদের অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো নথি জমা দেননি।

সাবেক প্রক্টর ও আইআইইউসির সহযোগী অধ্যাপক ড. কাউসার আহমেদও একই প্রক্রিয়ায় প্রায় ২৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন আইআইইউসি থেকে।

আইআইইউসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক তৌফিকুর রহমান ৩৪ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৫ টাকা নিজের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে তুলে নেন। গত ৬ মার্চ নতুন ট্রাস্টি বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি আর অফিসে আসেননি। পরে তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি এই টাকার হিসাব না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। গত ২৩ মে চট্টগ্রাম চান্দগাঁও থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক তৌফিকুর রহমান জামায়াত নেতা শামসুল ইসলামের আস্থাভাজন। তিনি নিয়মিত জামায়াতের নেতাদের হাতে আইআইইউসির ফান্ড থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে তুলে দিতেন।

আইআইইউসির একাধিক সূত্র জানায়, আইআইইউসির অভ্যন্তরীণ অডিট ও রি-অডিট টিম তাদের অনিয়ম তদন্তে অডিট কার্যক্রম চালু রেখেছে। জুলাই মাস পর্যন্ত পরিচালিত অডিটে জামায়াত নেতারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির চট্টমেট্রো-গ-১৩-৩৪১৮ প্রিমিও জি সিরিজের একটি নতুন গাড়ি এখনও জামায়াতের নায়েবে আমীর শামসুল ইসলাম পরিবহন পুলে ফেরত দেননি।

অভিযোগ রয়েছে, মাওলানা শামসুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক আহসানুল্লাহ ভূঁইয়া, উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আমীরুজ্জামান, দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমীর জাফর সাদেককে আই আইইউসির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাদের বিভিন্ন পদে নিযুক্ত করে এই উল্লেখযোগ্য অংকের ভাতাও দেওয়া হতো এই প্রতিষ্ঠান থেকে।

এছাড়া সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এলাকায় জামায়াতে নিজের আধিপত্য নিশ্চিত রাখতে শামসুল ইসলাম তার অনুগত কয়েকজন মাদ্রাসার শিক্ষককে আইআইইউসির শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে রয়েছেন লোহাগাড়া জামায়াতের আমীর ড. হেলাল উদ্দিন নোমান ও সেক্রেটারি ড. সাবের আহমেদ। যারা দুজনই ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। লোহাগাড়ার একটি অখ্যাত মাদ্রাসা থেকে আইআইইউসির সরাসরি প্রভাষক পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ১২ বছর আগে নিয়োগ পেলেও তারা এখনও প্রভাষক পদ ডিঙাতে পারেননি। কারণ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা তারা প্রকাশ করতে পারেননি। যদিও তিন বছর পরই গবেষণা প্রকাশ হয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির আবেদনের সুযোগ রয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!