মোটে ৫০ রোগী করোনার চিকিৎসা নিচ্ছে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায়, সবাই ছুটছে শহরে

পথে সংক্রমণ ছড়িয়েই উপজেলা থেকে শহরে আসছেন রোগীরা

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে গত ৯ দিনে ১২৩টি নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন ৭২ জন। গত ২৪ ঘন্টায় সেখানে মিলেছে ১৪ জন করোনা পজিটিভ। এর আগের ২৪ ঘন্টায় ১৫ নমুনা পরীক্ষায় ১১ জনই ছিল করোনা পজিটিভ। এই যখন অবস্থা, তখন এই উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাত্র ২ জন। বাকি ৮ জনকে শহরের হাসপাতালে রেফার করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা, কেউ কেউ নিজের উদ্যোগে এসেছেন শহরে।

এই চিত্র শুধু সন্দ্বীপের নয়। পাশের উপজেলা মিরসরাইয়েও শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত গত পাচঁ দিনে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন যথাক্রমে ৩৭, ৩৬, ৩৩, ৩৮ ও ২৭ জন। এই উপজেলায় প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে গড়ে ৪০ থেকে ৫০টি। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাত্র ৩ জন রোগী। উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও করোনা রোগী বেশি যে হাটহাজারীতে, সেখানেও উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬ জন।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় যেখানে প্রতিদিন গড়ে আড়াই শতাধিক রোগী করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন, সেখানে ১৪ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন সবমিলিয়ে ৫০ জন। বাকি রোগীরা দলে দলে যাচ্ছেন শহরের দিকে। অথচ এই ১৪ উপজেলার ১০টি উপজেলাতেই রয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন।

উপজেলার রোগীদের শহরমুখো হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে দুটি বড় সমস্যা দেখছেন করোনা চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। প্রথমটি হলো সংক্রমণ ছড়ানো আর দ্বিতীয়টি হলো শহরের হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত রোগীর চাপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পজিটিভ এসব রোগী উপজেলা থেকে শহরে আসার পথে সংক্রমণ ছড়িয়েই আসছেন। এর পাশাপাশি নিজেদের ভোগান্তিও বাড়াচ্ছেন। আর যাত্রাপথের ধকলে অবস্থার অবনতিও হচ্ছে। কিন্তু এর বদলে প্রাথমিক অবস্থায় উপজেলা পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে বরং বেশি সুবিধা হতো তাদের জন্য।

কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন রোগী নেই— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দুই ধরনের তথ্য মিলেছে। স্থানীয়দের মতামত, উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় মানুষজন শহরে ছুটছে। অন্যদিকে দায়িত্বশীলরা বলছেন, সুবিধা সবখানেই আছে তবে মানুষ শহরের হাসপাতালে বেশি আস্থা রাখছে। অন্য একটি মতও পাওয়া গেছে। আর সেটি হলো উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরা করোনা চিকিৎসা এড়িয়ে যেতে চান। তবে কারণ যাই হোক উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে সামনের কঠিন দিনগুলো সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে এই বিষয়ে মোটামুটি সকলেই একমত।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য ২০ বেডের বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে। স্থানীয় সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে এই অত্যাধুনিক আইসোলেশন সেন্টারটি চালু করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ সেখানে করোনারোগীদের ভর্তি করাতে চায় না। এভাবে অযত্নে ও অব্যবহারে আইসোলেশন সেন্টারটিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের নয়টি সিলিন্ডার নষ্ট হয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। এই উপজেলায় প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন লোকের শরীরে পজেটিভ শনাক্ত হলেও আক্রান্তরা নিজের বাড়িতে কিংবা শহরের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ছুটে যান। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, অন্যান্য রোগীদের নিরাপত্তার কারণে সেখানে করোনা রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না।

ফটিকছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ইমরুল কায়সার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার চিকিৎসায় বেশিরভাগ রোগীরই বিশেষ কোনো চিকিৎসা লাগে না। বেশিরভাগ রোগীই সময়মত সঠিক ওষুধ আর অক্সিজেন পেলে সুস্থ হয়ে যায়। এখন তো প্রায় সব উপজেলাতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন আছে।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী কেন কম থাকে— এমন প্রশ্নের উত্তরে মিরসরাই উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মিজানুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে সাধারণত মডারেট রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সিরিয়াস রোগী হলে আমরা রাখি না। করোনা রোগীও সেরকম। মডারেট রোগী হলে আমরা রাখি। কিন্তু রোগীর যদি কন্টিনিউ অক্সিজেন দরকার হয়, তাহলে আমরা রাখি না।’

এই উপজেলায় এখন পর্যন্ত সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই বলেও জানান ডা. মিজানুর রহমান। চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার মধ্যে মিরসরাই ছাড়া আরও যে তিনটি উপজেলায় এখন পর্যন্ত সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই সেগুলো হলো সন্দ্বীপ, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া।

সন্দ্বীপ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এই মুহূর্তে ২ জন রোগী আছে। আমরা ৮ জনকে চট্টগ্রাম রেফার করেছি। বাকিদের অনেকে নিজের মত করে চট্টগ্রাম চলে গেছে চিকিৎসার জন্য। অনেকে হোম আইসোলেশনে আছে।’

তবে এক্ষেত্রে কোন্ অবস্থা পর্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা হবে— এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১২ লিটার অক্সিজেন দেওয়ার পরেও যদি কোনো রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৮ এর নিচে নেমে যায়, তাহলে সেই রোগী যাতে না উপজেলার হাসপাতালগুলো না রাখে— এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

উপজেলা পর্যায়ে করোনার চিকিৎসার সকল সুযোগ ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ রয়েছে জানিয়ে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ মনিটরিং করা প্রয়োজন— এমন মন্তব্য করে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায় সব উপজেলায় এখন সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন বসানো হয়েছে। সব রকমের বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের জন্য খাবারের পয়সাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে তেমন রোগী নাই। সবাই শহরের দিকে ছুটছে। এতে সংক্রমণ ছড়ানোর পাশাপাশি শহরের হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ সৃষ্টিতে জোর দেওয়া দরকার। নাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’

তবে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে দাবি করে সামনে তা আরও উন্নতি করার বিষয়ে ভাবছেন জানিয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সব উপজেলাতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মানুষ শহরমুখী। তবু আমরা এটাকে আরও ভাল করার বিষয়ে চেষ্টা করছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!