দেখা নেই ইলিশের, খালি হাতে ফেরা জেলেদের দুশ্চিন্তা ঋণ শোধ নিয়ে

দেখা মিলছে না কাঙ্খিত ইলিশের। সাগর থেকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। ভরা মৌসুমে যেখানে জেলেদের মুখে হাসির ঝিলিক থাকার কথা, সেখানে অধিকাংশ জেলেরই মুখ মলিন। ইলিশ না পাওয়ায় একদিকে ঋণ পরিশোধ, অপরদিকে সংসার চালানোর দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে জেলেদের। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের জেলেরা বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে শিকার হচ্ছেন এমন পরিস্থিতির।

গত বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ পাওয়া গেলেও এ বছর সাগর থেকে অনেকটা খালি হাতেই ফিরছেন জেলেরা। অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে রেকর্ডসংখ্যক ইলিশ মাছ, কিন্তু মিরসরাই উপকূলে তার ব্যতিক্রম চিত্র— সাগরে ইলিশ নেই, জালে ধরা পড়ছে নামেমাত্র ইলিশ।

এদিকে ভরা মৌসুমে ইলিশ না পাওয়ায় চরম দুর্ভোগ কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো। জেলেরা জানান, সাগরে যাওয়া আসার তেল খরচের টাকাই উঠছে না। ইলিশের প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরার ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ সময় মিরসরাইয়ের জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। তাছাড়া তখন বেড়িবাঁধ এলাকায় কোস্টগার্ড টহলে থাকে।

দীর্ঘ এই সময় পরে জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে গেলেও ইলিশের দেখা মিলছে না। সাগরে মাছ না পাওয়ায় এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে দুর্বিসহ দিন কাটছে জেলেদের। এদিকে ইলিশের মৌসুমের শুরুতে নৌকা, জাল কেনা এবং মেরামতের জন্য ধার-দেনাসহ স্থানীয় পর্যায়ে ঋণ করে জেলেরা। মৌসুম এলে চার-পাঁচ মাস ইলিশ শিকার করে। কিন্তু সেই মাছ বিক্রির আয় দিয়ে দেনা ও কিস্তির ঋণ শোধ দেন। বাকি টাকায় সংসার চলে। কিন্তু আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন এই চিন্তায় দিন কাটছে জেলেদের।

সাহেরখালী ইউনিয়নের ডোমখালী এলাকার জেলে মৃদুল জলদাস জানান, মুহুরী প্রজেক্টের স্লুইসগেট খুলে দেওয়ায় এদিকের স্রোত বেড়ে গেছে। সবগুলো মাছ দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। এখন ইলিশ ধরার মৌসুম কিন্তু স্লুইসগেটের ৪০টি দরজা না খুলে দিত তাহলে এই মিঠা পানি আমাদের এলাকাতেই থাকতো, আমরা মাছ ধরতে পারতাম। গেলো বছর প্রচুর মাছ পাওয়া গেছে কিন্তু এবছর তার ছিটেফোটাও পাচ্ছি না।

ডোমখালী এলাকার সীতাকুণ্ড পয়েন্টের জেলে হরিলাল জলদাস জানান, সাগরে মাছ নেই। দুঃখ দুর্দশায় দিন কাটছে আমাদের। ছোট কিছু মাছ পাওয়া যাচ্ছে যা দিয়ে তেলের পয়সা উঠাতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

জেলেরা জানান, সাধারণত জুন থেকে আগস্ট— এই তিন মাস জেলেদের জন্য বহু কাঙ্খিত। মূলত বর্ষার এই তিন মাসের দিকে তাকিয়ে জেলেরা সারাবছর প্রহর গোণেন। কারণ প্রতিবছর এ সময় সমুদ্রে প্রচুর ইলিশের দেখা মেলে। আর এই ইলিশ বিক্রির অর্থ দিয়েই চলে সারা বছরের সংসার।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডোমখালী বেড়িবাঁধে মাছ ধরার ট্রলারে কিছু ছোট আকারের ইলিশ নিয়ে ফিরে এসেছেন জেলেরা। তারা জানান, প্রতিদিন আশা নিয়ে তেল খরচ করে সাগরে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু সবই ছোট মাছ, ইলিশের দেখা নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভরা মৌসুমেও মিরসরাইয়ে রূপালী ইলিশের বড় আকাল চলছে। জেলেরা জীবনবাজি রেখে ইলিশের প্রধান উৎস বঙ্গোপসাগরের গভীরে গিয়ে পর্যাপ্ত ইলিশ পাচ্ছে না। আর কখনও কখনও অল্প কয়েকটি ইলিশ ধরা পড়লেও এক সাথে সাগরে যাওয়া একদল জেলের ভাগে পড়ছে সামান্য কয়েকটি করে। আর দিনের পর দিন এ অবস্থা চলতে থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন স্থানীয় বাজারে।

এ সময় উপজেলার হাটবাজারে ইলিশে ভরা থাকার কথা। কিন্তু দেখা মিলছে না ইলিশের। নামে মাত্র সামান্য ছোট ইলিশ দেখা গেলেও অপ্রতুলতার জন্য আকাশছোঁয়া দাম। তাই কিনতে পারছেন না সাধারণ মানুষজন। আবার ভরা মৌসুমেও এ হাহাকার বিপদে ফেলেছে জেলেদের। ঋণ করে ইলিশ শিকার ও ব্যবসায় যারা নেমেছেন, তাদের দিন দিন সুদ বাড়ছে।

অন্যদিকে বাকিতে রসদ কিনে সময়মতো শোধ করতে না পেরে দেনায় ডুবছেন জেলেরা। সরেজমিনে উপজেলার বড় দারোগারহাট, বড়তাকিয়া, হাদি ফকির হাট, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া বাজারে গিয়ে ইলিশের আকাল পরিলক্ষিত হয়েছে। বড়দারোগাহাট ও মিঠাছড়া বাজারে ইলিশ দেখা গেলেও তা আকারে ছোট এবং মাঝারী। তাও এসব চট্টগ্রামের ফিশারীঘাট থেকে আসছে।

বড় দারোগারহাট বাজারের প্রবীণ মাছ বিক্রেতা হরি জলদাশ বলেন, ‘ইলিশের কথা উঠলে বড় দুঃখ লাগে। এই মৌসুমে আমরা শুধু ইলিশ বিক্রি করেই চলতাম। মাত্র ১০-১২ বছর আগেও এই সময় সাগর পাড়ে ইলিশের ছড়াছড়ি ছিল। দাম খুব বেশি হওয়ায় জেলেরা অনেক সময় বাজারেও আনতে চাইতো না মাছ। কিন্তু এখন ইলিশ তেমন একটা পাওয়া না যাওয়ায় জাটকা আকৃতির ইলিশ আড়াই থেকে ৩০০ টাকা এবং মাঝারি সাইজের ইলিশ ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। এছাড়া বড় ইলিশ তো কেজি ৭০০-৮০০ থেকে এক হাজারের ওপরেও বিক্রি হয়।’

উপজেলার ডোমখালী জেলে পাড়ার সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র জলদাশ জানান, ‘ফেনী নদীর মুহুরী প্রজেক্ট এলাকাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টের স্লুইসগেটের দরজাগুলো খুলে দেওয়ায় স্রোত বেড়ে গেছে সাগরের। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কলকারখানার বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করে ইলিশের প্রজনন ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর প্রভাবে এখানকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রবাহে ইলিশের সময়টা অনেক পিছিয়ে গেছে।’

এ বিষয়ে মিরসরাই উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাল জলদাশ বলেন, ‘ভরা মৌসুম হলেও বঙ্গোপসাগরের মিরসরাই-সন্দ্বীপ চ্যানেলে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও আমরা আশা ছাড়িনি। আগামী পূর্ণিমার জো-তে হয়ত এই আকালের অবসান হবে।’

ইলিশের এই আকালের কথা জানিয়েছেন মিরসরাই উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদও। তিনি বলেন, ‘তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ শেষে জানা যাবে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইলিশ প্রজনন কেন্দ্রের মধ্যে মিরসরাইয়ের সাহেরখালি হাইতকান্দি পয়েন্ট অন্যতম। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের প্রভাবে এই বিচরণ এলাকা থেকে ইলিশ সরে গেছে।’

কেএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!