ঝরনাধারায় লুকানো বিপদের বীজ, একের পর এক প্রাণহানি

মিরসরাই

সাবধানতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে মিরসরাইয়ের ঝরনাগুলো এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও ঝরনাগুলোতে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। গত ৪ বছরে ১০ পর্যটক নিহত ও আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।

নজরকাড়া পাহাড়ি এই প্রাকৃতিক ঝরনাই মিরসরাইয়ের সুনাম ছড়িয়েছে সারাদেশে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঝরনা দেখার জন্য পর্যটকরা ছুটে আসছেন। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নামে। উপজেলার ৯ স্তর বিশিষ্ট খইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, সহস্রধারা, মহামায়া, বাওয়াছড়া, রূপসী ঝরনা, বোয়ালিয়া ঝরনা, হরিণাকুণ্ড ঝরনা, সোনাইছড়ি ঝরনা নজর কেড়েছে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের। তবে ঝরনাগুলোতে প্রশাসনের কোন নজরদারি না থাকাতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। তবুও ঝরনার পানিতে একটু শরীর ভিজিয়ে নিতে ছুটে যাচ্ছে শত মানুষ।

সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ১৫ আগস্ট। উপজেলার বড় কমলদহ রূপসী ঝরনা কূপে ডুবে নিহত হন মেহেদী হাসান প্রান্ত (২১)। মেহেদী হাসান নাটোর জেলার নাটোর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামের মো. নুরুল আমিনের ছেলে। তারা চট্টগ্রাম শহরের কর্নেলহাট প্রশান্তি আবাসিক এলাকায় থাকতেন।

২৬ জুলাই খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে এসে ঝরনার ওপর থেকে পা পিছলে পড়ে নাম আবু আল হোসাইন মেমোরী (২৯) নামে এক পর্যটক নিহত হন। তার বাড়ি বগুড়া সদর থানায়। তিনি ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় সেইফটি কনসালটেন্ট বিডি প্রতিষ্ঠানের আর্কিটেকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।

২৮ জুন খৈয়াছড়া ঝর্নায় আনোয়ার হোসেন নামে এক পর্যটক ওপর থেকে পড়ে নিহত হন। তিনি ফেনী সদরের আব্দুল মজিদের পুত্র। ২ এপ্রিল খৈয়াছড়া পাহাড়ি এলাকায় ঝরনার ওপর থেকে পা পিছলে পড়ে মো. আশরাফ হোসেন (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত আশরাফ ফটিকছড়ি উপজেলার জাফতনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত নাজিম উদ্দিনের সন্তান।

এর আগে ১৭ জুলাই মহামায়া লেকের পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয় শাহাদাত হোসেন (২২) নামে এক যুবক। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ১৯ জুলাই শাহদাতকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। তার বাড়ি মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নে।

২০১৮ সালে ১৫ আগস্ট নয়দুয়ারিয়ার নাপিত্তাছড়া ঝরনার কূপে ডুবে অনিমেষ দে (২৭) নামে এক পর্যটক নিহত হন। তিনি ফটিকছড়ি উপজেলার নিরঞ্জন দের ছেলে। একই বছরের ২৪ আগস্ট বড়কমলদহ রূপসী ঝরনায় ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায় সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক। তার বাড়ি সীতাকুন্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায়।

ওই বছরের ১৫ জুলাই খৈয়াছরা ঝরনার সাতটি স্তরের পঞ্চম স্তরে ওঠার পর স্থানীয় এক পর্যটক পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সময় তাকে ধরতে যান ওয়াসিম আসগর নামের অপর এক পর্যটক। ওই পর্যটক সামান্য আঘাত পেলেও ওয়াসিম পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়। এতে মারাত্মক আহত হন তিনি।

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর উপজেলার নাপিত্তাছড়া ঝরনায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুন (২২) মৃত্যু হয়। তিনি ফেনী জেলার শর্শদি এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে। ১২ জুলাই উপজেলার বোয়ালিয়া ঝরনা দেখতে এসে আটকা পড়ে ১৫ পর্যটক। চার ঘণ্টা চেষ্টার পর তাদের উদ্ধার করে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিসের একটি দল। এছাড়াও ঝরনার ওপর থেকে পড়ে আহত হয়েছে আরও অর্ধশত মানুষ।

রূপসী ঝরনা কূপে ডুবে নিহত মেহেদী হাসান প্রান্ত (মাঝখানে)
রূপসী ঝরনা কূপে ডুবে নিহত মেহেদী হাসান প্রান্ত (মাঝখানে)

শুভ সংঘের মিরসরাই উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নাঈম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড়ি ঝিরি পথে চলার ট্রেনিং না নিয়ে ঝরনাগুলো দেখতে আসা খুবই বিপজ্জনক। এছাড়া মিরসরাইয়ের সামাজিক সংগঠনগুলো ঈদের ছুটিতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট বিতরণ করে পর্যটকদের সচেতন করলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমবে।’

বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) সভাপতি মো. সরওয়ার উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পর্যটকদের জন্য সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি। খৈয়াছড়া, সহস্রধারা, নাপিত্তা ছড়া, লবণাক্ষ ছরা, বাওয়া ছড়া, কমলদহ ছড়া, সোনাই ছড়া ঝরনা এলাকায় নিরাপদে যাওয়ার জন্য ২০ ইকো গাইডকে নিয়োগ দিয়েছি। পর্যটকরা যদি ঝরনা এলাকায় যাওয়ার সময় ইকো গাইডদের সাথে নিয়ে যায় তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।’

খইয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘মূলত দায়িত্বহীনতা ও অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে ঝরনার উপরে উঠে সেলফি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়।’

মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন অফিসার মো. তানভির আহম্মদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঝরনাগুলোতে প্রশাসনের নজর দেয়া প্রয়োজন। পর্যটকদের গাইড দিতে হবে কোন স্থানে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে, কোন স্থানে গেলে নিরাপদ তাহলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।’

মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, ‘মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে ঝরনা দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো পর্যটক আসে। ঝরনা এলাকাগুলোতে যদি পর্যটন মন্ত্রণালয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে তাহলে প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব। এখানে কোন নিরাপত্তা না থাকায় ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা পর্যটন এলাকাগুলোতে বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শীঘ্রই সর্তকতামূলক সাইনবোর্ড দেবো।’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!