গ্রামীণ কল্যাণের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতি

গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণের অনুমোদনহীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জালিয়াতি করে প্রেসক্রিপশন দেয়া ও চিকিৎসার নামে প্রতারণা করায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়েছে। গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকসহ চারজনকে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।

বুধবার (২১ অক্টোবর) সাতকানিয়ার বাসিন্দা ভুক্তভোগী শরীফুল ইসলামের পক্ষে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী মামুনুল হক চৌধুরী এ নোটিশ পাঠান।

গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেন্টার কো-অর্ডিনেটর হাসিবুর রহমান ও চন্দনাইশের বাসিন্দা শারমিন সুলতানা প্রমিকে নোটিশের ‘প্রাপক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্তির ১০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ না দিলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

নোটিশে বলা হয়, সরকারের অনুমোদন ছাড়াই চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ৩০টি জেলায় ১২৫টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণ। এর মধ্যে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত একজন চিকিৎসা সহকারী চিকিৎসক বা ‘ডা.’ পরিচয় দিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। এসব প্রেসক্রিপশনে এখতিয়ারের বাইরের ওষুধও লিখছেন। আদালতে মিথ্যা মামলার কাজে ব্যবহারের জন্য জালিয়াতি করে প্রেসক্রিপশনও দেয়া হয়েছে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তদন্তেও চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য উঠে এসেছে।

এতে আরও বলা হয়, গ্রামীণ কল্যাণের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৩০টি জেলায় ১৪টি আঞ্চলিক অফিসের অধীনে তাদের ১৩৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। অথচ ২১ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে রেজিস্ট্রি করা স্বাস্থ্যসেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রামীণ কল্যাণের স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে মাত্র ১০টি; এর মধ্যে ৭টি টাঙ্গাইলে, পটুয়াখালী, চাঁদপুর ও বগুড়ায় রয়েছে একটি করে। সে হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রির বাইরে থেকে গেছে গ্রামীণ কল্যাণের আরো ১২৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রেজিস্ট্রি না করায় এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন, আয়কর প্রত্যয়ন পত্র, ভ্যাট রেজি. নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) চুক্তিপত্র নেই বলে প্রতীয়মান হয়।

নোটিশে বলা হয়েছে, গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে জালিয়াতি করে দেয়া প্রেসক্রিপশন দিয়ে ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ চারজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে উক্ত মামলার বিবাদী শরীফুল ইসলাম গত বছরের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন বরাবর একটি আবেদন করেন। সে আবেদন তদন্তে উঠে আসে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নানা অনিয়মের তথ্য।
এতে উল্লেখ করা হয়, নারী নির্যাতন মামলা করার সময় উপস্থাপন করা উক্ত প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন মো. হাসিবুর রহমান। অথচ সেদিন শুক্রবার (১ নভেম্বর) ছুটির দিন হওয়ায় গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ ছিল। যার কারণে রোগী রেজিস্ট্রারে ১ নভেম্বর কারও নাম পর্যন্ত উল্লেখ নেই। আরো উল্লেখ করা হয়, ডিএমএফ ডিগ্রিধারী চিকিৎসা সহকারী মো. হাসিবুর রহমান গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেন্টার কো-অর্ডিনেটর হিসেবে আছেন। চিকিৎসা সহকারী হয়েও হাসিবুর রহমান নিজেকে ‘ডা. (ডাক্তার)’ উল্লেখ করে স্বাক্ষর-সিলসহ শরীফুলের স্ত্রী শারমিনকে উক্ত প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন। এমনকি কথিত রোগী শারমিনকে না দেখেই হাসিবুর প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন, যা দিয়ে পরে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করা হয়। উক্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য গত ১ জানুয়ারি লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হানিফকে দায়িত্ব দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন। সরেজমিন তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে গত ১৫ জানুয়ারি সিভিল সার্জন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। এতে ডা. হানিফ উল্লেখ করেন, “২০১৯ সালের ১ নভেম্বর উল্লেখ থাকা যে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেটি যাছাই করার জন্য গত ৯ জানুয়ারি সকালে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন ১ নভেম্বর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী রেজিস্ট্রারে কারও নাম নেই। কারণ শুক্রবার হওয়ায় সেদিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ ছিল। তদন্ত চলাকালে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্য কেন্দ্র সরকার অনুমোদিত কিনা এ ধরনের কোন প্রমাণপত্র তারা দেখাতে পারেননি। চিকিৎসক না হয়েও বেআইনিভাবে নামের আগে ডা. পরিচয় উল্লেখ করে হাসিবুর রহমান প্রেসক্রিপশনে দিয়ে আসছেন। চিকিৎসা সহকারী হাসিবুর রহমান এখতিয়ারের বাইরে ওষুধও প্রেসক্রাইব করে আসছেন।”

নোটিশে বলা হয়, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই নানা অনিয়মের মাধ্যমে গ্রামীণ কল্যাণের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো চলছে। ভুয়া মামলার প্রয়োজনে গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র তাদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিনেও জালিয়াতি করে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ কল্যাণ বৈলতলী স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামের এই প্রতিষ্ঠানটি চালানোর জন্য সরকারি অনুমোদন নেই। এমনকি প্রতিষ্ঠানটিতে প্যাথলজির পরীক্ষা হলেও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর লাইসেন্সও নেই তাদের। এটি দণ্ডনীয় অপরাধ, চরম দায়িত্বহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।

নোটিশ গ্রহীতাগণ পরস্পর যোগসাজসে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে মিথ্যা তথ্য উল্লেখ করে প্রেসক্রিপশন সৃজন করে নোটিশদাতার আর্থিক, মানসিক ক্ষতি, মানহানি করে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন উল্লেখ করে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় লিগ্যাল নোটিশে।

এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!