শ্যালক-দুলাভাই দুজনেরই আছে গাড়ির ‘রোগ’। দুজনেই এমপিপুত্র। রাস্তায় নামলে দুজনেই বেপরোয়া। মানুষ হত্যাসহ দুজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে বহু অভিযোগ। এদের একজন ‘দুলাভাই’ হলেন ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজী সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিম। নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ খান ও তার স্ত্রীর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ার পর উল্টো তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়ে এখন কারাগারে আছেন তিনি। অন্যদিকে ‘শ্যালক’ হলেন নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল করীম চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরী। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাবাব চৌধুরীর বড় বোন জারিন চৌধুরীর সঙ্গে ইরফান সেলিমের বিয়ে হয়।
শাবাব চৌধুরী এএন্ডজে গ্রুপ নামে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তার বাবা সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানটি শিপিং ও স্টিভিডোরসহ বন্দরভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর কার্যালয় আগ্রাবাদের বনানী কমপ্লেক্স ভবনে।
ইরফান সেলিমের শ্যালক শাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম গুরুতর অভিযোগ আসে ২০১৮ সালের ১৯ জুন। ওইদিন শাবাবের চালানো প্রাইভেট কারটি এক ব্যক্তিকে চাপা দিলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। ওই ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, বেপরোয়া গতিতে আসা গাড়িটি প্রথমে ফ্লাইওভারে এক পথচারী পায়ের ওপর তুলে দেয়। তিনি (পথচারী) ওই গাড়ির বাম্পার ধরে ফেলেন। গাড়িটি ব্যাক গিয়ারে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। গতি বাড়িয়ে তিনি আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যান। ওই পথচারী ছিটকে ফ্লাইওভারের গার্ডারে গিয়ে পড়েন। মুহূর্তেই মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ওই পথচারীর। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
এই ঘটনায় নামমাত্র একটি মামলা হলেও নিহত ব্যক্তির হতদরিদ্র পরিবার নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ একরামুল হক চৌধুরীর অর্থবিত্তের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সাংসদের পরিবারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয় নিহতের পরিবার।
অল্পের জন্য বেঁচে যান পুলিশ সদস্যরা
শাবাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযোগটি ওঠে চলতি বছরের ১১ জুলাই। চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজারে এমপিপুত্র শাবাব তার দ্রুতগামী গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দেন খোদ পুলিশের গাড়িকেই। এ ঘটনায় অল্পের জন্য কয়েকজন পুলিশ সদস্য প্রাণে রক্ষা পান। ওই দিন রাত নয়টার দিকে নগরীর লালখানবাজারে ঢোকার মুখে হাইওয়ে প্লাজার গলির সামনে আগে থেকে টহলে থাকা পুলিশের অপেক্ষমাণ একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় বিপরীত দিক থেকে দ্রুতবেগে আসা একটি বিলাসবহুল গাড়ি। গাড়িতে থাকা খুলশী থানার এসআই আনোয়ার হোসেন ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে ওই গাড়িটিকে আটকে ফেলেন। এ সময় শাবাব চৌধুরী নিজেকে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর পুত্র পরিচয় দিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। উল্টো পুলিশকেই হুমকি দেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে।
লালখানবাজারে সংঘটিত ওইদিনের ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আছে। ওই ঘটনার পর রাতেই শাবাব চৌধুরীকে খুলশী থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও ঢাকার এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে গভীর রাতে তিনি ছাড়া পান।
গাড়িচাপায় হত্যার বিনিময় ২০ লাখ টাকা
২০১৮ সালের ১৯ জুন রাত সাড়ে দশটার দিকে রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে বেপরোয়া গতিতে আসা একটি প্রাইভেট কার এক ব্যক্তিকে চাপা দিয়ে দ্রুত বিজয় সরণির দিকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় সেলিম ব্যাপারী (৪৫) নামে এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। নিহত ওই ব্যক্তির গ্রামের বাড়ি বরিশালে। তিনি দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে মহাখালী ডিওএইচএসের নাওয়ার প্রোপার্টিজের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করে আসছিলেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন শামীম আশরাফী ওই সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘দুর্ঘটনাটি যখন ঘটে তখন ওই প্রাইভেট কারটির পেছনে ছিলেন একজন মোটরসাইকেল আরোহী। দ্রুত পালানো গাড়িটিকে ওই মোটরসাইকেল আরোহী অনুসরণ করা শুরু করেন এবং চিৎকার করে আশপাশের সবার সহযোগিতা চান। এ সময় কয়েকজন বন্ধুসহ তিনিও (শামীম) একটি প্রাইভেট কারে ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেল আরোহীর চিৎকার শুনে তাদের প্রাইভেট কারটিও ঘাতক গাড়িটিকে অনুসরণ করে। তারা দেখতে পান গাড়িটি সংসদ ভবনের উল্টো পাশে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অবস্থিত ন্যাম ফ্ল্যাটের ভেতরে গিয়ে ঢোকে। ওই মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে তারাও ন্যাম ভবনের ভেতরে ঢোকেন।’
ওই প্রত্যক্ষদর্শী আরও জানান, ‘‘ন্যাম ভবনের ভেতরে ঘাতক গাড়িটি থেকে এক তরুণ নেমে বলে, ‘এটা আমার এলাকা, ‘কে কে আসবি আস।’ এ সময় ওই তরুণের সঙ্গে তাদের কথাকাটাকাটি হয়। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসে এবং তরুণটিকে শাবাব নাম ধরে ডাকতে থাকে। এ সময় এসব লোকজন ও দায়িত্বরত আনসার ও কেয়ারটেকাররা জানায়, শাবাব চৌধুরী নোয়াখালীর এমপি একরাম চৌধুরীর ছেলে। এরপর তাদের ন্যাম ভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়।’
শামীম আরও জানান, মোটরসাইকেল আরোহী ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক গাড়ি ও এর চালকের ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। কিন্তু তাকে হুমকি ধমকি দিয়ে সেসব ছবি ও ভিডিও ফোন থেকে মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়।
ওই সময় মানিক মিয়া এভিনিউর ৫ নম্বর ন্যাম ভবনে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে ৪ ও ৫ নম্বর ভবনের মাঝখানে উত্তরপাশে দাঁড়িয়ে এমপি একরামুল করীম চৌধুরীর ছেলে ও তাদের একাধিক গাড়িচালক বহিরাগত কয়েকজনের সঙ্গে কথাকাটাকাটি করছিল। এ সময় আমি পানি আনতে গিয়েছিলাম। তখন দেখি তাদের গাড়িটা সামনে ভাঙা। আমি চালকের কাছে জানতে চাইলাম কী হয়েছে? কিন্তু কেউ কিছু প্রথমে বলল না। পরে আরেকবার জিজ্ঞাসা করার পর সে বলে বাসে দুর্ঘটনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বাইরের আরও কিছু লোকজন দেখলাম। একটা মোটরসাইকেল দেখলাম। মোটরসাইকেল থাকা ছেলেটাকে এমপির ছেলে ও গাড়ির চালক মিলে মারধর করে মোবাইল রেখে দিয়েছে। মোবাইল দিয়ে সে নাকি ভিডিও করছিল।’
পরে ঢাকার কাফরুল থানা পুলিশের তদন্তেও বের হয়ে আসে, ওই অডি জিপ গাড়িটি ছিল নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল হক চৌধুরীর। গাড়িটিতে সাংসদের স্টিকারও লাগানো ছিল। গাড়িটি একরামুল হক চৌধুরীর স্ত্রী কবিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার শিউলির নামে নিবন্ধিত। তবে ঘটনার সময় সাংসদ কিংবা তার স্ত্রী গাড়িতে ছিলেন না। সেটি চালাচ্ছিলেন সংসদ সদস্য একরামুল হক চৌধুরীর ছেলে শাবাব চৌধুরী। মামলার এজাহারেও গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৭৬৫৫ উল্লেখ করা হয়।
তবে এই ঘটনায় কাফরুল থানার পুলিশ বাদী হয়ে সড়ক দুর্ঘটনা আইনে (নম্বর ১৮) একটি মামলা দায়ের করে। এমনকি এই ঘটনায় গাড়িচালক ও গাড়িটিকেও আটক করা হয়নি। পুলিশ এই ঘটনায় এমপিপুত্র শাবাবকে রক্ষার জন্য সব চেষ্টাই করে গেছে।
নিহত গাড়িচালক সেলিম ব্যাপারীর হতদরিদ্র পরিবার নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ একরামুল হক চৌধুরীর অর্থবিত্তের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্যই হয়েছে। সাংসদের পরিবারের পক্ষ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেওয়ার প্রস্তাবে শেষপর্যন্ত রাজি হন নিহতের পরিবার। এছাড়া প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী।
ওই সময় নিহত সেলিম ব্যাপারীর বোনের স্বামী আবদুল আলিম বলেন, ‘মহাখালীর ডিওএইচএসে নাওয়ার প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হোসেনের উপস্থিতিতে আপস বৈঠক হয়েছে। সেলিমের স্ত্রী চায়না ব্যাপারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এমপি সাহেব।’
শাবাব বললেন
দুলাভাই ইরফান সেলিমের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাবাব চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি তো আমার আপন ভাই না। আর আইন আইনের গতিতে চলবে। এখানে আমার কিছু বলার নেই।’
ঢাকায় গাড়িচাপা দিয়ে এক চালককে হত্যা এবং টাকার বিনিময়ে আপসের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে শাবাব চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকায় আমার সাথে কোনো সমস্যা হয়নি। আমার সাথে সমস্যার প্রশ্নই আসে না।’
সিপি