ইস্টার্ন ব্যাংকে ১৩ কোটির জালিয়াতি, দুদক এড়িয়ে তড়িঘড়ি মামলা থানায়

অভিনব কায়দায় গ্রাহকের ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পাশ কাটিয়ে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) কর্তৃপক্ষ। এতে বিস্ময় প্রকাশ করে দুদক বলছে, ঘটনায় মূল হোতাদের বাঁচাতেই তড়িঘড়ি এ মামলা করা হয়েছে।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, এ মামলা কোনভাবে থানায় দায়ের করা যায় না। কারণ এই ঘটনায় একটি মামলা দুদকে শিডিউলড অবস্থায় রয়েছে। আত্মসাতের ঘটনাটি হয়েছে চট্টগ্রামে, মামলার জন্য দুদক কর্মকর্তারা আদালতে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু অভিযুক্তদের বাঁচাতে দুদককে পাশ কাটিয়ে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে কর্মকর্তারা এসে মামলা দায়ের করেছেন থানায়।

১৯৯২ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি শওকত আলী চৌধুরী। সারাদেশে ব্যাংকটির মোট ৮৫টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগেই রয়েছে ব্যাংকটির ২৫টি শাখা। নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় এ ব্যাংকের কর্পোরেট শাখাসহ চট্টগ্রামে ৪৮টি এটিএম বুথ রয়েছে।

যেভাবে ঘটে অভিনব জালিয়াতি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২০১৬ সালের ১২ জুন কনা দে নামের একজন গ্রাহক চট্টগ্রামের চান্দগাঁও শাখায় একটি এফডিআর (নম্বর ০০৭১৪৪০১১৫৫৪২) করেন। সাম্প্রতিক সময়ে কনা দে’র টাকার প্রয়োজন হলে তিনি ওই এফডিআরের বিপরীতে ঋণ সুবিধা নিতে ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখায় যোগাযোগ করলে তার এফডিআরের রশিদটি দেখে শাখা ম্যানেজার গোলাম মহিউদ্দীনের সন্দেহ হয়। এরপর ম্যানেজার ব্যাংকের রেকর্ড ফাইল দেখে এটি নকল এফডিআরের রশিদ বলে ওই গ্রাহককে জানান। তিনি রেকর্ড দেখে ওই গ্রাহককে জানান, ২০১৬ সালের ১২ জুন কনা দে’র নামে কোন এফডিআর ইস্যু হয়নি। এরপর ম্যানেজার কনা দে’র সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন এ এফডিআরটি করিয়েছেন ব্যাংকের প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার ইফতেখারুল কবির। এতোদিন কনা দে’র টাকার প্রয়োজন না হওয়ায় এফডিআরের খোঁজখবর নেননি। তিন বছর পর হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হওয়ায় এফডিআরের বিপরীতে তিনি ঋণসুবিধা নিতে ব্যাংকে যান।

সূত্রে জানা গেছে, শুধু বেসরকারি ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংকের ওআর নিজাম শাখাতেই নয়, একই কায়দায় চান্দগাঁও শাখা থেকেও গ্রাহকের টাকা সরানো হয়েছে বলে ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে। এতে ওই দুই শাখার গ্রাহকের এফডিআর ও বিভিন্ন একাউন্ট থেকে প্রায় ১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, শুধু ইফতেখারুল কবির নয়, এ ঘটনায় ইস্টার্ন ব্যাংকের আরও একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার জড়িত থাকার সম্ভাবনা দেখছেন তদন্ত দল।

থানায় মামলা, তদন্তে জটিলতা
এ ঘটনায় গত ৭ আগস্ট ঢাকা প্রধান কার্যালয় থেকে একটি দল চট্টগ্রামে এসেই নগরের চকবাজার ও চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করার উদ্যোগ নেয়। ব্যাংকের এসএভিপি নিশাদুল ইসলাম বাদি হয়ে ওই ডায়েরি করেন৤ প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ওআর নিজাম শাখার প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার ইফতেখারুল কবির ও তার সহযোগী অপর কর্মকর্তা সামিউল সাহেদকে আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখায় তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়।

এরপর ৮ আগস্ট ইস্টার্ন ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখার প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার ইফতেখারুল কবিরের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় প্রথম দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এর ঘন্টাখানেকের মধ্যে ইফতেখারুল কবিরকে আগ্রাবাদ কমার্শিয়াল এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধান শুরুর আগে ইফতেখারুল কবিরকে গ্রেপ্তারের কারণে তদন্তের কাজ আরো জটিল হয়ে গেছে। তদন্তের আগেই তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানোয় তদন্তকাজে ব্যাঘাত ঘটছে।

জানা যায়, ঘটনার পর দুদকের তদন্ত দল অনুসন্ধানে মাঠে নামলে ইবিএল কর্তৃপক্ষ সুকৌশলে সোমবার (২৬ আগস্ট) দুদক কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করে দায় সারার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অভিযুক্ত যারা
জানা যায়, গত ৮, ১৬ ও ১৭ আগস্ট ইস্টার্ন ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের আইসিডি ম্যানেজার অনন্ত কুমার খাঁ বাদি হয়ে ইফতেখারুল কবিরকে প্রধান আসামি করে পৃথক পৃথক আটটি মামলা দায়ের করেন। ২০১৪ সালের ৩ জুলাই ইফতেখারুল কবির সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) হিসেবে নগরের ইস্টার্ন ব্যাংক ওআর নিজাম শাখায় যোগদান করেন। আত্মসাতের ঘটনার পর তাকে আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখায় বদলি করা হয়। তিনি চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার পূর্ব মাদারবাড়ি ৭৩ দারোগারহাট এলাকার আলমগীর কবিরের পুত্র।

ইফতেখারুল কবির (৩৬) ছাড়াও মামলার অন্য অভিযুক্তরা হলেন প্রায়োরিটি ব্যাংকিং ম্যানেজার সামিউল শাহেদ চৌধুরী (৩৭)। তিনি নগরীর ২১/এ মোমিন রোড ঝাউতলা সাফিউল ইসলাম চৌধুরীর পুত্র। তাকেও ঘটনার পর আগ্রাবাদ শাখায় বদলি করা হয়। হালিশহরের রামপুরা এলাকার পানির কল জাপানি বাড়ির কাশেমের পুত্র জাকির হোসেন বাপ্পি (৩৬)। বাপ্পির স্ত্রী ও লাবিবা বুটিকসের স্বত্ত্বাধিকারী ফারজানা রহমান ফেন্সি। নগরের খুলশী থানার বি ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৩ নম্বর লেইনের ৪৯২/৫৬০ নম্বর বাড়ির আনোয়ারুল ইসলামের পুত্র মাহমুদুল হাসান (৩৫)। হালিশহরের হালিশহরের রামপুরা এলাকার পানির কল জাপানি বাড়ির ভবন খায়ের ম্যানসনের বাসিন্দা আজম চৌধুরী (৫৪)। পূর্ব মাদারবাড়ির দারোগারহাট রোডে আবুদল সবুর মাস্টার বাড়ির আবদুল মালেকের পুত্র আব্দুল মাবুদ (৩৪)। এদের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে তহবিল স্থানান্তর, আরটিভিএস ও ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে কাগজপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

দুদককে কেন পাশ কাটানো?
ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার এরিয়া প্রধান ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকের মামলাটি ভুলবশত চান্দগাঁও থানার দায়ের করা হয়েছে। তবে মামলাটি আদালতের মাধ্যমে দুদকে যাবে। ২৬ আগস্ট দুদক অফিসে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।’

ইস্টার্ন ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ের হেড অফ কমিউকেশন (মিডিয়া) জিয়াউল করিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকের গ্রাহকের ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রায়োরিটি কর্মকর্তা ইফতেখারুল কবিরসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে সিএমপির চান্দগাঁও থানায় আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

তবে দুদকের মামলাটি কেন তড়িঘড়ি থানায় দায়ের করা হল—এমন প্রশ্নের জবাব তিনি কৌশলে বারবার এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘মামলা যেহেতু হয়েছে। এটির তদন্তভার আদালতের মাধ্যমে দুদকে যাবে।’

দুদকের আইনজীবী যা বললেন
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকের ১৩ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলাটি ছিল দুদকের। যেহেতু আত্মসাতের ঘটনাটি হয়েছে চট্টগ্রামে। মামলাটির জন্য আদালতে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ব্যাংকটির হেড অফিস থেকে কর্মকর্তারা এসেই ইচ্ছাকৃতভাবে মামলাটি দায়ের করে থানায়।’

তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আরও বলেন, ‘তদন্ত শুরু করার আগে ইফতেখারুল কবির নামের ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের কারণে এই মামলার তদন্ত আরো জটিলতার দিকে যেতে পারে।’

মন্তব্যে রাজি নন পুলিশ কর্মকর্তা
জানতে চাইলে নগরের উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর জোন) বিজয় বসাক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন, ‘গত ৮ আগস্ট ইস্টার্ন ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ইফতেখারুল ইসলামকে মূল আসামি করে পৃথকভাবে আটটি মামলা দায়ের করা হয়েছে থানায়। ইস্টার্ন ব্যাংক হেড অফিসের কর্মকর্তা অনন্ত কুমার খাঁ এ মামলার বাদি।’

মামলাটি থানায় রেকর্ড করা নিয়ে বিজয় বসাক মন্তব্য করতে রাজি না হলেও বলেন, ‘মামলার তদন্তভার দুদকে চলে গেছে।’

দুদকের বক্তব্য
দুদক জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ উপ পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন ব্যাংকের মামলাটি এখনও দুদক কার্যালয়ে পৌঁছেনি।’

তবে তিনি নিশ্চিত করেছেন, সোমবার (২৬ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুদক কার্যালয়ে এসে ইস্টার্ন ব্যাংকের পক্ষে আজিম উল্লাহ নামে এক ব্যক্তি একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!